শুধু তোমার জন্য আমি

শুধু তোমার জন্য আমি
তৃষ্ণা স্পর্শী
সূচনা পর্ব
কারোর ভালো করতে গিয়ে নিজেই যে ফেঁসে যাবে এটা জানলে কখনও অন্যের ভালো করতে আসতো না উক্তি। অবশ্য না এসেও কোনো উপায় ছিলো না। জানাসত্ত্বে তো আর নিজের বান্ধবীর জীবন নষ্ট হতে দেয়া যায় না। আর বান্ধবীর জীবন বাঁচাতে গিয়ে যে নিজের জীবন নিলামে উঠবে তাও তো জানত না সে।
বাবার কথায় ধ্যান ভাঙে উক্তির।
‘তাহলে এই বিয়েটা তুমি করছো? তাই তো?’
উক্তি গলার কাছে দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসা কান্নাগুলোকে নিজের মধ্যে চাপা দিয়ে বলে
‘আমি এই বিয়ে করতে চাই না, আব্বু।’
রাফাত সাহেব মেয়ের কথা শুনে ক্রোধে জ্বলে উঠলো। চাপা ধমকের স্বরে বলল
‘এই কথা তোমার এমন ঝামেলা পাকানোর আগে ভাবা উচিত ছিল। এখন এসব বলে কোনো লাভ নেই।’
উক্তি ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল
‘আমি কি জানতাম নাকি যে পরিস্থিতি এমন হয়ে যাবে। আর তুমি সব জানার পরেও এমন এক ফাজিল লোকের সাথে আমার বিয়ে দিবে?’
‘তুমি এমন সিনক্রিয়েট না করলে কখনও তোমাকে শীর্ষর সাথে বিয়ে দিতাম না আমি। কিন্তু এখানে দোষ তোমার। তাই ঐ পরিবারের সম্মান রক্ষা করার দায়িত্বও তোমার। যেহেতু দুই পরিবারই এই ব্যাপারে রাজি তাই এখানে তোমার অমতের কোনো যৌক্তিক কারণ আমি দেখছি না।
আর কথা রইল শীর্ষর! বিয়ের আগে সবার জীবনেই কোনো না কোনো অতীত থাকে। সেই অতীতকে খতিয়ে দেখতে গেলে দেশের প্রায় অর্ধেক পুরুষই অবিবাহিত থেকে যাবে। আর বিয়ে তাকেই করা উচিত যার অতীত নয় ভবিষ্যৎ সুন্দর। আশা করি তুমি আমার কথা বুঝতে পেরেছো।’
কান্নার চোটে কোনো কথা বলতে পারলো না উক্তি। আর বলবেই বা কা’কে? ওর সবচেয়ে আপন মানুষটাই তো ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। অভিমানে জর্জরিত উক্তি নীরবে বিসর্জন দিল অশ্রুকণাদের।
রাফাত সাহেব স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল
‘আমেনা, মেয়েকে তৈরি করে নিয়ে এসো।’
কথাটা বলেই চলে গেলেন রাফাত সাহেব। মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ল উক্তি। নীরব কান্নারা এবার পরিণত হলো গুনগুনানিতে। আমেনা বেগম ছুটে এসে মেয়ের পাশে বসলেন। অনেক আকাঙ্ক্ষার তার এই মেয়েকে টেনে নিলেন বুকের মাঝে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়েকে অনেককিছুই বুঝানোর চেষ্টা করছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে গলার স্বর। তার সাথে কেঁপে উঠছে বুকের মাঝে গুঁজে থাকা উক্তি। ওর কানে ঢুকছে না মায়ের মুখনিঃসৃত কোনো বাণী। তার বদলে চোখের সামনে নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা।
আজ উক্তির কাছের বান্ধবী ফাইজার বিয়ে। সেই সুবাদেই বান্ধবীর বাড়ি আসে উক্তি। কিন্তু ওর মূল উদ্দেশ্য বিয়ে হতে দেখা নয়। বিয়ে ভাঙা। তার যথার্থ কারণও আছে।
সে কাল টুকটাক কেনাকাটার জন্য শপিংমলে গিয়ে ফাইজার হবু বর শীর্ষকে একটি মেয়ের হাত ধরে হাঁটতে দেখেছে। শুধু তাই নয় দুজনকে একসাথে কফিশপে বসে কফিও খেতে দেখেছে। এতটুকু খুবই নরমাল ছিল। কিন্তু সবচেয়ে হতবিহ্বল করে দেওয়ার মতো ঘটনা হলো মেয়েটা শীর্ষকে জড়িয়ে ধরে ওর বাম গালে আবেশে চুমুও খেয়েছে। আরও অনেককিছুই দেখতে পারতো যদি মা ও’কে বগলদাবা করে না নিয়ে আসতো।
উক্তি এই ঘটনা ফাইজাকে জানানোর জন্য বারকয়েক ফাইজার নাম্বারে ডায়ালও করে। কিন্তু ও’কে ফোনে পাওয়া যায় নি। মুক্তি আপুর বাবু অসুস্থ হয়ে পড়ায় সন্ধ্যায় হলুদের অনুষ্ঠানেও আসতে পারে নি উক্তি। তাই সব ফাইজাকে জানানোর জন্য বিয়ের দিন তাড়াতাড়িই চলে এসেছে ফাইজাদের বাড়িতে। ফাইজা তখন পার্লারে যাওয়ার জন্য গোছগাছ করছিল। উক্তিকে দেখে হালকা হাসল সে। পরক্ষণেই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে শুধালো
‘কালকে আসিস নি কেন অনুষ্ঠানে? ওরা সবাই কতো মজা করলো কিন্তু তার মাঝে তুইই নেই। এটা কিন্তু ঠিক হয়নি উক্তি। বিয়ে তো আমি একবারই করবো। বারবার তো আর করবো না, তাই না? এই মুহূর্তটা কি আমি আর ফিরে পাব?’
‘তন্দ্র অসুস্থ ছিল। আর তুইতো জানিসই ও অসুস্থ হলে অনেক জ্বালায়। আর আপুকে এই অবস্থায় ডিস্টার্ব করলে বাড়িতে আরও অশান্তি হতো। তাই আর আসতে পারিনি। তোকে কল করেছিলাম তো। তুইতো রিসিভ করিসনি।’
গোছগাছ শেষ হতেই ফাইজা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল
‘আমার ওতো ফুরসত আছে নাকি বল তো। সবার কেন্দ্রবিন্দু হলাম আমি। সারাক্ষণ এই অনুষ্ঠান, এই থিমের ফটোসেশান, ওই থিমের হেনতেন। যত্তসব আজিব কারবার। আগে জানলে মসজিদে বিয়ে করতাম। এসব আদিখ্যেতা আর ভালো লাগে না ভাই।’
উক্তি ফাইজার কথাগুলো শুনলো মন দিয়ে। কোথায় যেন এক পরাজিত সুর। সবসময়ের চঞ্চল ফাইজা আর আজকের এই জোর করে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে রাখা ফাইজার মধ্যে বিস্তর ফারাক। সবই প্রিয়জনদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্টের প্রভাব। আর ভাবতে পারলো না উক্তি। মনে মনে নিজের কথাগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে বলল
‘আমার তোকে কিছু বলার আছে, ফাইজা।’
ফাইজা আয়নার ভিতরের উক্তির দিকে তাকিয়ে বলল
‘তুই আবার এতো ফর্মালিটি মেইনটেইন করে আমার সাথে কথা বলছিস কেন? হতে পারে আমি আজকের অনুষ্ঠানের মেইন রোল। কিন্তু তোর কাছেতো সেই আগের জনই। যা বলতে চাস বলে ফেল। আবার ইমোশনাল কিছু বলিস না কিন্তু।’
‘আই থিংক শীর্ষ অন্য আরেকজনের সাথে কমিটেড। কালকে আমি ও’কে একটা মেয়ের সঙ্গে দেখলাম।’
উক্তি একে একে সবকিছু খুলে বলল ফাইজাকে। সব শুনে ফাইজা পলকহীনভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
সারা রুম জুড়ে নীরবতা। এরই মাঝে ফাইজার মা এসে ফাইজাকে বলল
‘কিরে তোর গোছগাছ হলো?’
পরক্ষণেই উক্তির দিকে নজর পড়তেই হেসে বলল
‘তুমি কখন এলে, উক্তি?’
‘এইতো একটু আগেই,আন্টি।’
‘দেখ তো কাহিনী। আমি তোমার আসার কথা জানিই না। কিছু মনে করো না মা। এতো কাজের ভীড়ে আমার পাগল হওয়ার দশা। তোমার আঙ্কেল গিয়ে বসে আছে সেন্টারে। তাই এদিক সব আমার দেখা লাগছে। আমি মহিলা মানুষ কি এত কিছু বুঝি, বলো তো? তুমি নাস্তা করেছো? আসো, নাস্তা করতে আসো।’
‘আপনি ব্যস্ত হবেন না, আন্টি।আমি নাস্তা করেই এসেছি।’
‘তুমি কি ফাইজার সাথে পার্লারে যাবে?’
‘পার্লারে কেন? ও’কে না বিউটিশিয়ান বাসায় সাজাতে আসবে?’
‘এর কথা আর বলো না। কথা তো হয়েছিল যে বাসায় আসবে সাজাতে। এখন নাকি তার এক বান্ধবীর বোন তার কাছে সাজতে চাচ্ছে। তাই সে আর বাসায় এসে ও’কে সাজিয়ে দিতে পারবে না। ফাইজারই ঐখানে গিয়ে সাজা লাগবে। আমার হয়েছে যতো মুসিবত। তুমি কি ওর সাথে যাবে একটু?’
উক্তি একপলক ফাইজার দিকে তাকালো।তারপর বলল
‘আচ্ছা, আন্টি।’
ফাইজার আম্মু খুশি হয়ে সেখান থেকে চলে গেল।
‘তুই এখনও এই বিয়েটা করবি?’
‘হুম। না করার তো কারণ দেখছি না। আর বড়লোক ছেলেদের দুই-চারটা এমন থাকেই। বিয়ের পরে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসারী হয়ে গেলেই হবে।’
‘তুই কি নিজেকে কম মনে করছিস? ইউ ডিজার্ভ মোর বেটার দ্যান হিম।’
‘নিজেকে কম মনে করার কি আছে? আমি তো ওর থেকে কমই। আর মানুষের সবসময় মনে হয় দে ডিজার্ভ বেটার। বাট আমরা সময়,সুযোগ আর মানুষকে হারিয়েই বুঝি যে দে ওয়য়ার পার্ফেক্ট। এন্ড গড ইজ দ্যা বেস্ট প্লানার। আর আমি আমার নিয়তিকে মেনে নিয়েছি।
এখন তাড়াতাড়ি চল। পরে না আবার সাজতেই দেরি হয়ে যায়।’
কথাটা বলেই ফাইজা লেহেঙ্গার ব্যাগটা হাতে তুলে নিল।
‘নিজের ভালো পাগলও বুঝে। ভালোবাসায়, না, না মোহে অন্ধ হয়ে গেছিস তুই।’
ওর কথার প্রত্যুত্তরে ফাইজা কিছুই বলল না। হালকা হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অসহায়, বিমূঢ় উক্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল সেই পথেই।
পার্লারে এসে ফাইজা আর উক্তি দেখলো পার্লারের মহিলাটি অন্য একজনকে সাজাতে ব্যস্ত। সে ব্রাইডের মেকওভার করতে করতে বলল
‘বসুন,ম্যাম। আমার এই আধাঘন্টার মতো সময় লাগবে। ওনার মেকওভারটা হয়ে গেলেই আপনারটা শুরু করবো। আজকে আমার সহকারী আসেনি। তাই এই ভোগান্তি। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, প্লিজ।’
মহিলাটির কথায় ওরা বসল দুজনে। ফাইজা ব্যস্ত হয়ে পড়লো ফোন স্ক্রল করায়। আর উক্তি বসে রইল অপাংক্তেয় হিসেবে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে ফাইজার চুল সেট করার মাঝখানে ফাইজা উক্তিকে বলল
‘তুই বিয়েতে কি পড়বি?’
‘নতুন করে আর কি পড়বো? এইটা পড়েই থাকব।’
ফাইজা উক্তির এহেন কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলল
‘তুই শিউর?’
ফাইজার কথায় নিজের দিকে তাকাল সে। পড়নে একটা লিনেন কাপড়ের থ্রিপিস। কোথাও আয়োজন ছাড়া বের হওয়ার ক্যাজুয়াল লুক। আসলে ও’তো আর বিয়েতে এটেন্ড করতে আসেনি। এসেছিল অন্য কিছুর জন্য। তা আর হলো কোথায়?
‘তোর বাসায় কল করে বলবি ড্রেস পাঠাতে?’
‘না, অনেক সময় লাগবে। আমি আশেপাশের কোনো শপিংমল থেকে একটা শাড়ি কিনে নিয়ে আসি। তোর তো অনেক টাইম লাগবে, না?’
‘হুম। লাগবে এই ঘণ্টাখানেকের বেশি। তুই সময় নিয়ে শাড়ি চুজ করতে পারিস। তোর তো এমনিতেও এগুলোতে সময় বেশি লাগে।’
‘আচ্ছা। আসছি।’
বলেই বেরিয়ে গেল উক্তি। কিন্তু ফিরে আর ফাইজাকে দেখতে পেল না ও। পার্লারের মহিলাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল ফাইজাকে নাকি ওর এক কাজিন এসে নিয়ে গেছে। বাড়িতে নাকি কোন রিচুয়ালস ছিল।
এ বিষয়ে আর ঘাটাল না উক্তি। সে নিজেকে কৃত্রিমতার আবরণে ঢাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
উক্তি সেন্টারে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল মানুষের উপচে পড়া ভীড়। একটু আগেই বরপক্ষ এসে পড়েছে তাই সেন্টারে গিজগিজে অবস্থা। সে এসব ভীড় ছেড়ে একটু খোলামেলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো।
হুরমুর করে উক্তির কাছে দৌড়ে আসলেন ফাইজার আম্মু শায়লা বেগম। হড়বড় করে বললেন
‘ফাইজা কোথায়, উক্তি?’
শায়লা বেগমের এমন হড়বড় করে কথা বলার ধরনে ভড়কে গেল উক্তি। পরক্ষণে তার করা প্রশ্নে থমকে গিয়ে বলল
‘ফাইজা তো অনেক আগেই পার্লার থেকে চলে এসেছে। কি রিচুয়ালস ছিল নাকি তাই।’
‘কি বলো! ও’তো বাসায় আসেনি। এখন আমি কি করবো? ওর আব্বুকে কি বলবো আমি? হায় আল্লাহ! কোথায় গেল মেয়েটা আমার?’
শায়লা বেগম এমন অবস্হায় চিৎকার চেঁচামেচিও করতে পারলেন না। বরযাত্রী এসে বসে আছে। কিন্তু কনেরই কোনো খবর নেই। কি করবেন তিনি? তাদের এতো কষ্টে অর্জিত সম্মান বুঝি এভাবেই ধুলোয় মিশে যাবে! আর কিছু ভাবতে পারলেন না তিনি। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগে শুধু উক্তির অনিন্দ্য সুন্দর চিন্তিত মুখটাই দেখতে পেলেন।
শায়লা বেগম চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করলেন এক অচেনা জায়গায়। তার আশেপাশে অনেক মানুষের ভীড় নেই। রুমটাতে খালি উক্তি আর ফায়াজ সাহেব। ফায়াজ সাহেবের গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসলো তার কানে
‘তুমি সত্যি বলছো উক্তি যে শীর্ষের অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে জেনেই ফাইজা এই বিয়ে থেকে পালিয়েছে?’
‘জি, আঙ্কেল। এছাড়া ফাইজার কোনো সম্পর্কও ছিল না কারো সাথে।’
‘তুমি এগুলো গিয়ে বরপক্ষের সামনে বলতে পারবে?’
‘অবশ্যই পারবো।’
স্বামীর কথায় শায়লা বেগম বললেন
‘কি বলছো তুমি ফাইজার আব্বু? ফাইজা পালিয়েছে?’
স্ত্রীর কথা শুনে ফায়াজ সাহেব দাঁত কিড়মিড় করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন
‘হ্যা। তোমার গুণধর মেয়ে বংশের মুখে চুনকালি মেখে পালিয়েছে। তোমার মেয়েকে আমি হাতের কাছে পেলে কে*টে দু’টুকরো করে নদীতে ভাসাবো।’
‘এগুলো কি বলছো তুমি? আর এখানে শীর্ষর দোষ দেখছো না? এমন চরিত্রহীন ছেলের কাছে মেয়ে দেওয়ার থেকে মেয়েকে ফাঁ-সিতে ঝুলিয়ে মে-রে ফেলা ভালো।’
‘অযথা চেঁচামেচি করবে না। উক্তি? তুমি আমার সাথে আসো।’
ফায়াজ সাহেব আর উক্তি রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই গুনগুন করে কাঁদতে লাগলেন শায়লা বেগম। তার এতো আদরের মেয়েটা কোথায় গেল? তার নাড়িছেঁড়া ধন। এতো চাওয়ার মেয়ে। মোনাজাত তুলে মেয়ের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলেন তিনি।
শীর্ষর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে উক্তি। ওর চোখের দৃষ্টিতে রাগ আর ঘৃণা। অপরদিকে শীর্ষর চোখমুখ থমকানো। ফায়াজ সাহেব গমগমে গলায় বললেন
‘তোমার সাথে ফাইজার বিয়ে সম্ভব না, শীর্ষ। তোমার অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্কের কথা শুনে ফাইজা তোমাকে আর বিয়ে করতে চায় না।’
নিজের হবু শ্বশুরের মুখে এমন কথা শুনে ভড়কে গেল শীর্ষ। আশ্চর্য হয়ে বলল
‘আমার অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক! কি বলছেন আপনি?’
‘উক্তি ঐ ঘটনার সাক্ষী। উক্তি সবাইকে বলো।’
উক্তি ফায়াজ সাহেবের কথা শুনে নিজের বাবা আর শীর্ষর দিকে তাকালো। দুইজনের চোখেই রাগের ঝলক। উক্তি নিজের ক্রিমসন রেডে রাঙানো ঠোঁট দুটো হালকা ভিজিয়ে সব ঘটনা সংক্ষেপে বলল। সব শুনে শীর্ষ বলল
‘শিফার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আমরা কয়েকমাস আগেই আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছি।’
‘সম্পর্ক ছিন্ন করলে আপনাকে ঐ মেয়ে চুমু খাবে কেন?’
শীর্ষ উক্তির দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল
‘ওটা ভুল করে হয়েছে। ওর লুকানো আবেগ কাজ করেছে জাস্ট। আর কিছুই না। ওয়েট। আমি প্রমাণ দিচ্ছি।’
কথাগুলো বলেই শীর্ষ নিজের ফোন নিয়ে শিফাকে কল করে লাউড স্পিকারে ধরে। একটা রিং হতেই কল রিসিভ করে শিফা। নাক টেনে বলল
‘কি হয়েছে, ইসহাক?’
‘তোমার সাথে তো আমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। তাই না, শিফা? আমাদের দুজনের মধ্যে তো সব শেষ হয়ে গেছে, তাই না?’
‘হুম। কিন্তু তুমি এগুলো এখন জিজ্ঞেস করছো কেন, ইসহাক?’
‘কিছু না। ধন্যবাদ, শিফা।’
কলটা কেটে উক্তির দিকে তাকিয়ে বলল
‘এবার আপনার বিশ্বাস হয়েছে? আর কারো মনে আমার জন্য ফিলিংস থাকলে সেখানে আমার কিছু করার নেই নিশ্চয়ই?’
সব শুনে মাথা নত করে ফেলল উক্তি। চারপাশে শুরু হলো ফুসুর-ফাসুর। মানুষের কানা-কানিতে সেখানে কান পেতে রাখা দায়। বরপক্ষ তো বটেই কনেপক্ষের কেউ কেউও ফাইজার স্বভাবচরিত্র নিয়ে কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। এতোক্ষণের চাপা গুঞ্জন শেষমেশ স্ফুলিঙ্গের রূপ ধারণ করলো। শীর্ষর ফুফা জাকির হোসেন সম্বুন্ধির উদ্দেশ্যে বলল,
‘চলেন, ভাইজান। এখানে আর একপলও থাকবো না। আজই থানায় এই পরিবারের সবার নামে মানহানীর মামলা করবো। আমাদের সম্মান ধুলোয় মিশানো! এরা তো জানে না যে জাকির হোসেন কি জিনিস! এদের সবাইকে যদি চৌদ্দ শিকের ভাত না খাইয়েছি তাহলে আমার নামও জাকির হোসেন না। চলেন।’
ভগ্নি পতির হম্বিতম্বি রূপের বিপরীতে ইফাদ সাহেব দৃঢ় কন্ঠে বলল,
‘ছেলের বউ না নিয়ে আমি আজ বাড়ি ফিরবো না, জাকির।’
সম্বুন্ধির দৃঢ় গলায় বলা কথার বিপরীতে জাকির হোসেনের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। যেন এখনই সেগুলো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। তিনি নিজের বিস্ময় চেপে না গিয়ে বলল,
‘সব জানার পরেও আপনি এই মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিবেন! দেশে কি মেয়ের আকাল পড়ছে! আর আমাদের ছেলে কি এতোই ফেলনা যে, ওই মেয়ের আশায় ছেলের সারা জনম অপেক্ষা করতে হবে?’
‘ছেলে যেমন ফেলনা না, তেমনই আমার সম্মানও ফেলনা না। ছেলেপক্ষ দেখে যে এমন কাজে আমাদের সম্মান পুরো অক্ষুণ্ণ থাকবে এমন কোনো কথা নেই, জাকির। উল্টো লোকে নানান কথা রটাবে এটা নিয়ে। লোককে সেই সুযোগ দিতে আমি নারাজ। তাই আমি আজ ছেলের বউ সাথে নিয়েই বাড়ি ফিরবো।’
‘কিন্তু আপনি এখন কার সাথে ছেলের বিয়ে করাবেন? হুটহাট করে পাত্রী ঠিক করলেই হয়ে যায় না-কি? যাচাই-বাছাই এর ব্যাপার আছে না একটা?’
‘যাচাই-বাছাই করেই তো পানি এখানে এসে গড়ালো। এবার না-হয় যাচাই-বাছাই ছাড়াই করাই।’
নিজের কথা শেষ করে ইফাদ সাহেব রাফাত সাহেবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল
‘আমার সম্মান তো সব শেষই হয়ে গেল, ভাইজান। এখন আপনিই আমাকে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে পারেন। আপনার মেয়েকে আমার ছেলের জন্য ভিক্ষা চাইছি আমি। দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না। তাহলে আর আমি এ-ই সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না।’
কথা বলতে বলতে হাতজোড় করে ফেললেন তিনি। রাফাত সাহেব ইফাদ সাহেবের হাত ধরে বললেন,
‘আমার মেয়ের কাজে আমি আগে থেকেই লজ্জিত। আমাকে দয়া করে আর লজ্জায় ফেলবেন না। আমার আপনার সিদ্ধান্তে কোনো আপত্তি নেই। আপনি কাজী সাহেবকে বিয়ে পড়ানোর কথা বলুন।’
জাকির হোসেন যদিও ইফাদ সাহেবের মতের বিরোধিতা করেছেন, তবুও ইফাদ সাহেব নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। অনেক ভেবেই তিনি উক্তিকে নিজের ছেলের বউ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেননা উক্তির মাঝে তিনি একজনের ছায়া খুঁজে পেয়েছে যে কি-না শীর্ষকে আগলে রাখতো অনেক আদরে আর আহ্লাদে।
দু’হাতে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো উক্তি। দুচোখের কাজল লেপ্টে বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে আছে। টলমলে পায়ে হেঁটে ওয়াশরুমে ঢুকলো ও। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে এল। মুখ মুছলো মায়ের শাড়ির আঁচল দিয়ে। আমেনা বেগম পরম যত্নে মেয়ের মাথার হিজাব ঠিক করে দিয়ে কপালে চুমু খেলেন।
অপরদিকে বিয়েতে রাজি ছিল না শীর্ষও। কিন্তু পরিবারের সম্মানের জন্য হার মানতে হলো ও’কে। কাবিন নামায় ‘নূরনামা বিনতে ফাইজা’ নামের পরিবর্তে ‘সামরিয়া আফরিন উক্তি’ নাম দেখে মেজাজ গরম হলো ওর। তবুও নিজেকে দমিয়ে রেখে কাবিন নামায় সই করল সে। অবশেষে তিন কবুল বলে ও কাবিন নামায় সই করে কাগজে কলমে ও ধর্মীয়ভাবে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হলো দু’জনে।