ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

মধ্যরাতের অশরীরী আততায়ী

0

মধ্যরাতের অশরীরী আততায়ী

শাহীনুর আসিফ

সবু‌রের বর্ণনা শু‌নে তদন্ত‌টি‌মের প্রত্যেক সদস্য চুপ ক‌রে থা‌কেন কিছুক্ষণ। বিশ্বাস কর‌বো কি কর‌বো না এমন দোটানায় প‌ড়ে যায় তার‌া।
বিন্দুবা‌সিনী হাই স্কু‌লের অ‌ফিসরুম। স্কু‌লের বে‌শিরভাগ শিক্ষকই এখন প্রধান‌শিক্ষ‌কের রু‌মে ব‌সে আ‌ছেন। আবদুর রহমান সা‌হেব স্কুলের সব শিক্ষককে জরুরী তলব ক‌রে‌ছেন। কারণ স্কু‌লের অবস্থা আবারও ভয়াবহ! বেশ ক‌য়েকটা ক্লা‌সের ছাত্রী‌রা অদ্ভুত আচরণ শুরু ক‌রে‌ছে। প্রথ‌মে অষ্টম শ্রে‌ণির ছাত্রী‌দের ম‌ধ্যে সসস্যাটা দেখা দেয়। প‌রে আ‌স্তে আ‌স্তে অন্য ক্লা‌সের ছাত্রী‌দের ম‌ধ্যেও তা ছ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে। এই ক্লা‌সের মে‌য়েরা সবাই কেমন যেন অদ্ভুতভা‌বে হাস‌তে থা‌কে। প্রথ‌মে শুরু হয় রু‌বিনা‌কে দি‌য়ে। প‌রে একজন দু’জন ক‌রে ছ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে। এখন সেটা ক্লা‌সের গন্ডি ছা‌ড়ি‌য়ে অন্যান্য ক্লা‌সেও ছ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে‌ছে। কী অদ্ভুতভা‌বে মে‌য়েগু‌লো হে‌সে চ‌লে‌ছে। প্রধান‌শিক্ষক আবদুর রহমান সা‌হে‌বের নি‌র্দে‌শে ক‌য়েকজন শিক্ষক অষ্টম শ্রে‌ণির রু‌বিনা‌কে আন‌তে যায়। গ‌ণিত শিক্ষক দেবা‌শিষ বড়ুয়ার নেতৃ‌ত্বে শিক্ষক‌দের একটা দল রী‌তিমত ধস্তাধস্তি ক‌রে রু‌বিনা‌কে ধ‌রে নি‌য়ে আ‌সে। যেন কোন অপা‌র্থিব শ‌ক্তি ভর ক‌রে‌ছে ওর ম‌ধ্যে! ক‌য়েকজন শিক্ষকের স‌ম্মি‌লিত শ‌ক্তি‌তে রী‌তিমত লড়াই ক‌রে রু‌বিনা‌কে ধ‌রে আন‌তে হ‌য়ে‌ছে প্রধান শিক্ষ‌কের রুমে।
এই মুহূ‌র্তে সে ব‌সে আ‌ছে প্রধান‌শিক্ষ‌কের রু‌মে। আবদুর রহমান সা‌হে‌বের মু‌খোমু‌খি একটা চেয়া‌রে। এই রু‌মে ঢোকার পর থে‌কেই সে হেসে চ‌লে‌ছে। আবদুর রহমান সাহে‌বের ধমকে সে কিছুটা চুপ হ‌য়ে‌ছে।
রু‌বিনা কী হ‌য়ে‌ছে তোমার?
হেডস্যা‌রের ভরাটক‌ণ্ঠে সে চোখ তু‌লে তাকায়। পরক্ষ‌ণে অপা‌র্থিব হা‌সি‌তে ফে‌টে প‌ড়ে। তারপর হা‌সি থা‌মি‌য়ে ব‌লে-
বিরানভূ‌মি হ‌য়ে যা‌বে পু‌রো শহরটা। বিরানভূ‌মি হ‌য়ে যা‌বে…
আবদুর রহমান সা‌হেব চ‌ম‌কে ও‌ঠেন। এ‌তো রু‌বিনার গলা না! যেন কো‌নো এক পুরু‌ষের কণ্ঠ। নি‌জে‌কে সাম‌লে নি‌য়ে তি‌নি ব‌লেন-
কেন এমন কর‌ছো তু‌মি? আমা‌দের‌কে ভয় দেখা‌চ্ছো?
হি‌হি‌হি..
দাঁ‌তে দাঁত ঘ‌ষে কেমন ক‌রে যেন হা‌সে রু‌বিনা।
ভয়! ভ‌য়ের তো কেবল শুরুরে রহমান।
তি‌নি একটু ইতস্তত ক‌রে ও‌ঠেন। এতটুক মে‌য়েটা তাঁর নাম ধ‌রে ডাক‌ছে। কিন্তু এরচে‌য়ে ভয়ংকর ব্যাপার সে এবার একজন পূর্ণবয়স্ক নারীর ক‌ণ্ঠে কথা বল‌ছে।
কী‌রে ব্যাটা নারীদেহ তোর খুব প্রিয় না। নি‌জের বউ‌য়ের কা‌ছে সুখ পাস না! পর-নারীর দি‌কে চোখ যায় তোর। হি‌হি‌হি…সব ব‌লে দেব। দিব না কি রে?
আবদুর রহমান সা‌হেব ও‌ঠে প‌ড়েন চেয়ার থে‌কে। এই মে‌য়ের সাম‌নে ব‌সে থাকাটাও ঠিক হ‌বে না। ‌তি‌নি ও‌ঠে প‌ড়েন। পেছন থে‌কে রু‌বিনা কো‌নো এক অ‌চেনা ক‌ণ্ঠে চিৎকার কর‌তে থা‌কে-
আবদুর রহমান যাস নে পু‌রোটা শু‌নে যা। এখন লজ্জা কর‌ছে খুব! যখন আকাম ক‌রিস তখন হুঁশ থা‌কে না?
রহমান সা‌হেব দ্রুত রু‌মের বাই‌রে বারান্দায় গি‌য়ে দাঁড়ান। প‌কেট থে‌কে রুমাল বের ক‌রে মু‌খের ঘাম মু‌ছেন। তারপর হাত ইশারায় উপ‌স্থিত সব শিক্ষক‌কে ডা‌কেন। বিচ‌লিত ক‌ণ্ঠে ব‌লেন-
আপনারা তো সব দেখ‌লেন। এখন বলুন আমা‌দের কী করার আ‌ছে?
আমার ম‌নে হয় ভি‌ডিও কনফা‌রেন্সের মাধ্য‌মে শহর থে‌কে আসা সেই মে‌ডি‌কে‌ল টি‌মের সা‌থে কথা বলা দরকার।
বিজ্ঞান শিক্ষক আতাউর রহমান তার মতামত প্রকাশ ক‌রেন।
উপ‌স্থিত সব শিক্ষক তা‌তে সায় দেন।
ভি‌ডিও কনফা‌রে‌ন্সের মাধ্য‌মে কিছুক্ষণ আ‌গে মে‌ডি‌কেল টি‌মের প্রধান ডাক্তার সা‌মিরার সা‌থে কথা শেষ হ‌য়ে‌ছে বিন্দুবা‌সিনী বা‌লিকা বিদ্যাল‌য়ের শিক্ষক‌দের। ডা: সা‌মিরার ভাষ্যম‌তে ম্যাস‌ হি‌স্টিরিয়ায় আক্রান্ত রো‌গি‌রা এমন নানা রকম আচরণ কর‌তে পা‌রে। রু‌বিনা যেমন দু’‌তিন রকম ক‌ণ্ঠে কথা বল‌ছে ‌সেটাকে সাই‌কোল‌জির ভাষায় ব‌লে সে‌কেন্ড পা‌র্সোনা‌লি‌টি। তার অব‌চেতন মনই এরকম কর‌তে বাধ্য কর‌ছে। ডা: সা‌মিরা পু‌রো স্কুল কিছু‌দি‌নের জন্য বন্ধ রাখার পরামর্শ দেন। আর রু‌বিনা মে‌য়েটার জন্য কিছু ঘু‌মের ওষুধ, ফুড সাপ্লি‌মেন্ট প্রেসক্রাইব ক‌রেন তি‌নি। বয়ঃস‌ন্ধির এই সময়টায় ছে‌লে-‌মে‌য়ে‌দের মন এম‌নি‌তেই বি‌ক্ষিপ্ত থা‌কে। হর‌মোনাল কিছু প‌রিবর্তন হয়। যার ফ‌লে ম্যাস হি‌স্টি‌রিয়ার মত সমস্যা দেখা দি‌তে পা‌রে। সর্ব‌শেষ তি‌নি স্কু‌লের সকল শিক্ষক‌কে সতর্ক থাক‌তে এবং না ঘাবড়া‌নোর পরামর্শ দেন।
আবু‌লের পোস্টম‌র্টেম রি‌পোর্ট থানা পু‌লি‌শের কা‌ছে এ‌সে‌ছে। রি‌পো‌র্টে বলা হ‌য়ে‌ছে তা‌কে খুন করা হ‌য়ে‌ছে। খু‌নি ধারা‌লো কিছু দি‌য়ে তার বুকটা এ‌ফোঁড়-ও‌ফোঁড় করে ফে‌লে‌ছে! চোখগু‌লে‌াও ধারা‌লো কিছু ব্যবহার ক‌রে উপ‌ড়ে ফেলা হ‌য়ে‌ছে। কিন্তু টয়‌লে‌টের দরজা ছিল ভেতর থে‌কে বন্ধ করা। এমন কো‌নো লক না, যেটা বাই‌রে থে‌কেও চা‌বি দিয়ে খোলা যায়। অর্থাৎ ভেতর থে‌কে আবুল হো‌সেন একদম ছিটকা‌নি দি‌য়েই আট‌কে ছিল। তাহ‌লে বাই‌রের কা‌রো টয়‌লে‌টের ভেত‌রে ঢু‌কে তা‌কে হত্যা করা সম্ভব না! এমন য‌দি হয় আগে থে‌কেই ঘাতক ভেতরে আবু‌লের জন্য‌ অ‌পেক্ষা ছিল। তাহ‌লেও প্রশ্ন খেকে যার ঘাতক বন্ধ দরজা দি‌য়ে পালা‌লো কি করে।
গভীর রাত স‌খিনা বেগম তার দু’সন্তান নি‌য়ে শু‌য়ে আ‌ছে ঘ‌রে। সে কিছু‌তেই দু’‌চো‌খের পাতা বন্ধ কর‌তে পার‌ছে না। বি‌নিদ্র রাত কাট‌ছে সদ্য প্রয়াত স্বামী আবুল হো‌সে‌নের কথা ম‌নে ক‌রে। কত অদ্ভুত মানু‌ষের জীবন! মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আ‌গেও তার সা‌থে কথা হ‌য়ে‌ছে মানুষটার। তা‌দের ভাল-মন্দ জি‌জ্ঞেস ক‌রে‌ছে। আর সকাল হ‌তেই কি না শো‌নে সে মানুষটা নিহত হ‌য়ে‌ছে। কে বা কারা যেন ওয়াশরু‌মের ম‌ধ্যে নৃশংসভা‌বে খুন ক‌রে‌ছে তা‌কে! পু‌লি‌শের লে‌াক এমন সহজ-সরল খুব কমই দেখা যায়। অথচ এমন মানুষ‌কেই খ‌ুন হ‌তে হল! আহা এমন মানু‌ষেরও শত্রু থাক‌তে পা‌রে। এসব কথা ভে‌বে দু’‌চো‌খে অ‌ঝোরধারায় পা‌নি গ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে তার। ঠিক এমন সময় বাই‌রে টি‌নের দরজায় কে যেন কড়া না‌ড়ে। আবুল হো‌সে‌নের বাড়িটা টিন‌শে‌ডের। তিনরু‌মের ছোট বাসা। দ্বিতীয়বার কড়া নাড়ার আওয়াজ হ‌তেই স‌খিনা বেগম ভয়ার্ত ক‌ণ্ঠে জি‌জ্ঞেস ক‌রে- কে?
তারপর সে পা‌শে থাকা সেল‌ফোনের স্ক্রি‌নে সময় দে‌খে। রাত দুইটা বাজে। দ্বিতীয়বার কে বলার আ‌গেই একটা পুরুষ কণ্ঠ ব‌লে- স‌খিনা দরজা খোলো।
চম‌কে ও‌ঠে স‌খিনা। এ যে অ‌বিকল আবু‌লের কণ্ঠ! কিন্তু কী করে সম্ভব! স‌খিনা দ্বিতীয়বার কিছু বলার আ‌গেই আবারও দরজার ওপাশ থে‌কে ব‌লে- কী হল দরজাটা খোল স‌খিন‌া। এ‌তো দূর থে‌কে আসলাম দাঁ‌ড়ি‌য়ে থাকার জন্য!
মু‌হূ‌র্তের ম‌ধ্যে স‌খিনা যেন বর্তমানটা‌কে ভু‌লে যায়। লোপ পায় হিতা‌হিত জ্ঞান। পাগ‌লের মত ছু‌টে গি‌য়ে দরজার ছি‌ট‌কা‌নিটা খু‌লে দেয়। আকা‌শের আধখানা চাঁ‌দের আ‌লোয় দে‌খে আবুল দাঁ‌ড়ি‌য়ে আ‌ছে! তার চো‌খে যেন বড় অদ্ভুত স‌ম্মোহনী মায়া। স‌খিন‌ার ম‌নে হয় সে কত সহস্র যুগ পরে আবুলকে দেখ‌ছে! কোন কথা না ব‌লে হাত বা‌ড়ি‌য়ে দেয় সে। সে হা‌তে হাত রা‌খে স‌খিনা। ঠিক যেমন প্রথম যৌব‌নে হাত রে‌খে‌ছিল তারা। ত‌বে সেই হা‌তে উষ্ণতা ছিল। আর এই হাত বরফ শীতল।হোক বরফ শীতল তবু তো আবু‌লের হাত। স‌খিনা হাত ধরা মাত্র খুব দ্রুত ছু‌টে চ‌লে আবুল নি‌শীথরা‌তে গ্রা‌মের মে‌ঠোপথ ধ‌রে। তারপর এক সময় অন্ধকা‌রে মি‌লি‌য়ে যায়।

ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *