অক্টোবর ২৮, ২০২৪

শেষের কথোপকথন

“কথোপকথন” কবিতার কাব্যনাট্যরূপ

পারভেজ শিশির

চরিত্রঃ

[ মহুল ও হৃদি। ৩০ বছর বয়স ব্যবধানের দুই গুণমুগ্ধ কবিবন্ধুর, দুই আলাদা মহাদেশে বসবাস। কেউ কাউকে কখনও দেখেনি। কেবল ইথারে কথা হয়েছে ]

দৃশ্য ১: প্রান্তিক ভালোবাসা

[ স্থান: যশোরে শীতের সকাল, প্রান্তিক মফস্বল শহর। ঢাকায় শহুরে জীবন থেকে মুক্তি। চেনা বাতাসে মৃদু হিম ]

মহুল (আনন্দে)—

তোমার ভালোবাসায় এখনও ভালো আছি।

শীতের যশোরে এসেছি,

ঢাকার হইচই পেছনে ফেলে।

বৈদ্যুতিক ডাকে সব বলব তোমাকে—

ভেতর বাহির, সবকিছু।

তুমি কেমন আছো, এখনো কি আমাকে ভুলোনি?

হৃদি (উচ্ছ্বাসে)—

তোমাকে ভুলি কী করে…!

তুমি আর আমি—

একই শব্দের প্রতিধ্বনি,

ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশে বসেও—

আমাদের হৃদয়দুয়ারী এক।

“চোখের জলের তবে এত ছিল রঙ

এত ছিল প্রেম, তার এত প্রকরণ…!”

এই সুরে যেন সবকিছু ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়…

মহুল (হাসতে হাসতে)—

তোমার কথার সুরে যেন মনের বাঁশি বেজে ওঠে…!

কিন্তু, প্রমিথ্যিয়্যুস বলে ডাকছো কাকে?

তুমি কি জানো,

তোমার একটা মন্তব্যের অপেক্ষায় বসে বসে—

আমার মনও জ্বলতে থাকে…!

দৃশ্য ২: স্মৃতির অলকানন্দা

[ স্থান: লন্ডনের শ্যাডোয়েল স্টেশন। ঠান্ডা বাতাসে ঝলমলে লাল ডাবল ডেকার বাস ]

​হৃদি (মজা করে)—

এই যে, রোকো ইয়ার…!

এমন ক’রে লিখো না,

পাছে আমার ঘরণী তোমার এই “ক্ষীর প্রণয়” মন্তব্য দেখে ফেলে…!

আমার অলকানন্দা দশা হয়েছে, জানো?

তোমার প্রতি ভালোবাসা যেন—

অশরীরী কেউকেটা হয়েছে…!

মহুল (হাস্যরসে ভরা):

তুমি কি সত্যিই ভয় পাও, ঘরণীর সামনে আমার কথা বলতে?

আমার নাম আনোয়ার আর পারভেজ —

কোনোটাই তো মেয়েদের নাম নয়…!

তবু যেন শ্যাডোয়েল থেকে ভিক্টোরিয়া যেতে

হাসিহাসি খুশিখুশি সমযুগলদের আশ্চর্য দৃশ্য মনে পড়ে,

তোমার কথার শির শির অনুভব করি…

​হৃদি (বিনোদিত হয়ে):

তা একটু বিব্রত হতেই হয়,

তবে সে ততো মাথা ভেজে খায় না বলে’ই রক্ষে—

তুমি নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ূতে, আর আমি

সাব জিরো আর্কটিক ঝড়ের ভেতরে থেকেও

আমাদের এই বৈদ্যুতিক ডাকের উষ্ণতা কিন্তু রয়ে গেছে।

তুমি আমাকে হৃদি, আমি তোমাকে মহুল

এই সব মিষ্টি ডাকাডাকি… সত্যিই, পারি’ও…!

ভয় নেই, কোনো বিরহী কার্ডিনাল আমার জানালায় আঘাত করবে না…

দৃশ্য ৩: কান্‌হা ও রাধা

[ স্থান: যশোরের পুরানো বাসার বারান্দা, ছাতের দিকে চেয়ে থাকা। সন্ধ্যার নীল আলো ]

​মহুল (উন্মনা হয়ে)—

মন মোহন…! তোমার কাশী মথুরা ছেড়ে

এসো আমার চোখের আগে

তোমাকে ছাড়া আমার শান্তি নেই

কান্‌হা… সারাদিন কামনা করি তোমাকেই—

সাঁস্যো কি মালা প্যে স্যিমরু ম্যে পিঁ কা নাম…

হৃদি (আকুলতায়)—

যে গান তুমি আমাকে শুনিয়েছো

অবিশ্রান্ত তার মায়াজাল… আমি মন্ত্রমুগ্ধ

আচ্ছা তুমি কবিতায় কান্‌হা বলেছো, কে সে…!

কিন্তু এই নাম আমি আগে শুনিনি।

অষ্টম অবতার বিষ্ণু বুঝি,

কিন্তু তোমার কৃষ্ণ বর্ণনা যেন—

ন্যাপথ্যালিনের ঘ্রাণমাখা!

তুমি এসব স্বরলিপি কোথায় পাও?

মহুল (মৃদু সুরে):

আচ্ছা, শুনে নাও।

“রাস রাচাইয়্যা বৃন্দাবান্‌’কি গোকুল’কে বাসী,

রাঁধা তুম্হ‌রি দাসী…”

তুমি কি জানো,

এই কান্‌হা-র বাঁশির সুরে রাধা’রা—

উন্মাতাল হয়ে ওঠে, কর্পূরের মতো উবে যেতে চায়…!

হৃদি (দীর্ঘশ্বাস):

কিন্তু আমি তোমার এই রাধা নই,

আমি শুধু অপেক্ষার প্রহর গুনছি।

তুমি আছো, আবার নেই—

এই তোমার শব্দের সুরের, যেন চিরকালের প্রতীক্ষা…!

দৃশ্য ৪: বৈদ্যুতিক ডাক ও হৃদয়ের সুর

[ স্থান: শীতকালীন রাতের খোলা জানালা, জোছনার আভায় আলোকিত ]

​মহুল (আদুরে গলায়)—

তুমি জানো,

বৈদ্যুতিক ডাক বলতে ইলেকট্রনিক মেইল বুঝিয়েছি…!

এমন বরফকুঁচি বৃষ্টির মধ্যে

তুমি জানালা খুলে রেখো না,

কোনো বিরহী পাখি তোমার জানলার কাঁচে মুখ থুবড়ে পড়বে না।

তোমার জানালায় নয়, আমার হৃদয়ের গোপন কোণায়—

তুমি চিরকাল ভালো থাকো।

​হৃদি (একটু চুপ)

তুমি একা থাকো,

শরীরের দিকে কিন্তু খেয়াল রেখো

তোমার কাছে তো কোনো রাত দিন নেই

বিরহী পাখি বলো আর যাই বলো,

তোমাকে আমি ভুলছি না,

যদিও প্রায়ই মনে হয়, তোমাকে আমার মনে নেই…

​মহুল (মৃদু হাসি):

তুমি যদি কোনোদিন আমার সামনে আসো,

তাহলে মধ্যরাতের চন্দ্রাভায়,

আমরা এই দূরত্বের জ্বলুনির গ্র্যাফিটি,

এঁকে রাখব রাশম্যোরের দেয়ালে দেয়ালে।

কোনো কারণ নেই, কিছুই হবে না

তবু আমরা লিখবো—

এটাই আমাদের গল্প…!

দৃশ্য ৫: মহাকালের প্রান্তে

স্থান: দুটি মহাদেশ, ভিন্ন সময়ে বসে। কল্পনায় তাদের সংলাপ ভাসছে।

​হৃদি (আবেগময়):

তোমাকে ভোলার কোনো উপায় নেই।

প্রতিবার ফিরে এসে,

প্রতি প্রতিবার, ফিরে এসে

তোমার নামের মায়ামধু পান করে যাবো…

এই মহাকালের প্রান্তে—

তোমার নামেই হৃদয়ের গভীরে—

সব শব্দসুরের অমৃত রয়ে গেছে।

মহুল (স্বপ্নময় সুরে):

আমাদের এই হৃদয়দুয়ারীর সুরময় সঙ্গ—

যতদিন মহাকাল বয়ে চলবে,

ততদিনই আমাদের সতিনী’রা থাকবে…

তুমি আর আমি—

এই অসম প্রেমের গল্প,

এই বৈদ্যুতিক ডাক, এই শীত, ঐ বরফকুঁচি বৃষ্টি—

সবই অমর হয়ে যাবে।

​[ তারা দুজনেই আলাদা আলাদা মহাদেশে বসে, কিন্তু মনের ভেতর একই অনুভূতির প্রতিধ্বনি, একই রকম আকাশ… ]

অক্টোবর ২৮, ২০২৪

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *