খয়েরি সন্ধ্যের পাঁচালী
খয়েরি সন্ধ্যের পাঁচালী
পারভেজ শিশির
প্রথম দৃশ্য: বিদায়ের সন্ধ্যে
(মঞ্চে মৃদু আলো, ধীরে ধীরে অস্তগামী সূর্যের আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। অপরাজিতা ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে আমি।)
(বাতাসে যেন একটি অবরোহী কণ্ঠ উচ্চারণ করছে…)
“কত প্রহর ম’রে গিয়েছে, আমি ওর কন্ঠস্বর শুনিনি…
আমার পরাণপুষ্প অপরাজিতা আমাকে
জন্মের মতো ছেড়ে গেলেও ,
আমি ওর মতন মহৎ নই ব’লে
নিজের ব্যথায় নিজেই বিনামূল্যে কষ্ট পাচ্ছি…”
আমি (স্বগতোক্তি):
অপরাজিতা, তুমি জানো, কত কিছু জমা করে রেখেছি তোমার জন্যে…!
কত কথা, কত বিকেল, কত চোখের তৃষ্ণা,
তুমি কি কখনো নিতে চেয়েছো সেগুলো?
না হয়তো,
কেননা যার দেবার কিছু নেই, তার নীরবতায়
প্রকাশিত হয়েছে হাজার কথার প্রতিধ্বনি…
যেন পদ্মপাতার ওপর বৃষ্টির ফোঁটা,
অবিরাম পড়ে, থেমে যায়, আবার পড়ে।
আমি তোমার ওই অস্থিরতা টুকু দেখেছি, বুঝেছি,
তবু আমি তোমাকে কিছু বলতে পারিনি।
আমার এই ক্লান্তি এবার তবে শেষ হতে চলেছে…
দ্বিতীয় দৃশ্য: নিমগ্ন অপেক্ষা
(অপরাজিতা ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে, অতীতের স্মৃতিতে ডুবে যাই। ব্যাকগ্রাউন্ডে বৃষ্টি পড়ার শব্দ।)
আমি (স্বগতোক্তি):
সেদিনও বৃষ্টি পড়ছিল,
যেমন আজকেও,
আমার কবিতার মতো কথা, তোমাকে প্রথম স্পর্শ করেছিল।
তোমার চোখের ভেতর সেই মুহূর্তের চঞ্চলতা এখনো কিন্তু স্পষ্ট।
ওতে হাসি নেই, ভ্রু কুচকে যাচ্ছে না, তুমি স্থির
বৃষ্টি যেমন পদ্মপাতায় পড়ে, তুমি তেমনই বিদায়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে কেঁপে উঠলে।
তুমি তো জানো,
তুমি না ফিরলে আমার কবিতার পৃষ্ঠা সাদা হয়ে যাবে?
তুমি না জানলেও, আমি জানি কবিতারা কীভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে…
তৃতীয় দৃশ্য: বিদায়বেলার হুতাশ
(আমি হাত বাড়িয়ে অপরাজিতাকে ডাকছি। কিন্তু সে থামছে না। তার চোখে কান্না।)
আমি (জোরে):
শুধু একবার দাঁড়াও, অপরাজিতা…!
(অপরাজিতা থেমে মুখ ফিরিয়ে তাকায়। তার চোখ দুটো ভারী, দুঃখিত, ভেজা…)
তুমি কি জানো, আমি কেমনভাবে অপেক্ষা করি?
তুমি জানো, বুকের মধ্যে হৃদপিন্ড হারিয়ে গেলে কেমন লাগে?
তুমি কি দেখছো না, বিদায়ের এই সন্ধ্যে কতটা খয়েরি?
তুমি কি দৃষ্টিহীন হয়ে যাচ্ছো…!
অপরাজিতা (কান্নাভেজা কণ্ঠে):
না, আমি জানি না, আমি জানতে চাইনে…
আমি জানি না কেন এভাবে বিদায় নিতে হয়,
জানি না কেন ফেলে যাওয়া মুহুর্তগুলো আর ফিরে আসে না।
জানতে পেলাম না, কীভাবে ভালোবাসা দূরারোগ্য হয়
আমি শুধু জানি,
আমি ফিরব না, আমার ফেরা হবে…
তোমার কাছে আমার ফিরতে নেই…
(…এই কথাটার প্রতিধ্বনি হলো, একটা বজ্রপাতের শব্দের সাথে)
চতুর্থ দৃশ্য: নিশ্চুপ সন্ধ্যের অন্ধকারে
(অপরাজিতা চলে যাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি, কোনো কথা বলতে পারছি না। পুরো মঞ্চে নিস্তব্ধতা। বৃষ্টির শব্দ হালকা হয়ে এসেছে।)
আমি (স্বগতোক্তি):
শুধু একবার তাকিয়ে থাকো,
এই মুহূর্তটুকু জমা রাখো তোমার হৃদয়ে।
আমি বলেছি অনেক কিছু,
কিন্তু আসলে তোমাকে বলার কিছুই ছিল না।
তুমি যা জেনেছো, তা-ই যথেষ্ট।
আমাকে তুমি কয়েকটি মাত্র বসন্ত ভালোবেসেছো, এই ঢের…
(অপরাজিতা এক মুহুর্তের জন্য থামে, পেছন ফিরে তাকায়, চোখে মৃদুু উষ্ণ টলটলে জল। এরপর আর না দাঁড়িয়ে চলে যায়।)
পঞ্চম দৃশ্য: বৃষ্টির পরের নীরবতা
(আমি একা মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টি থেমে গেছে। মঞ্চে নিস্তব্ধতা। আলোর বিন্দু ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।)
আমি (স্বগতোক্তি):
তুমি বললে, “না”,
তোমার সেই একটুকু শব্দে ভেঙে গেলো সবকিছু।
কিন্তু আমি জানি,
এই “না”-এর ভেতর লুকিয়ে আছে হাজারো কথা,
হাজারো আবেগ, হাজার দিনের একটু একটু ক্ষয়
যা তুমি কখনো বলবে না, বাতাসে শূন্য হয়ে গিয়েছে
শুধু ‘না’ ব’লে বিদায় তো নিলে,
তুমি না হয় দাঁড়িয়ে থাকতে, আমি চলে যেতাম…!
কিন্তু আসলেই কি তুমি চলে গিয়েছ?
নাকি বৃষ্টির অর্থহীন শব্দে আমি তুমি আজও আমাদের অপেক্ষায়?
দুটো আলাদা পৃথিবীতে…! নাকি সব বিলীন…