ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

সাহিত্যের স্বরূপ

হারুন অর রশীদ

সাহিত্য মানুষের কথা বলে, সাহিত্য সমাজের কথা বলে। সমাজের আদিকালের কোন বিষয়ের ধারণা পেতে আমরা সেই সমাজের সেই কালের সাহিত্যের দ্বারস্থ হই। কেননা সাহিত্য সমাজের দর্পণ হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বচরাচরের যেকোনো বিষয় নিয়ে সাহিত্য রচিত হয়েছে, হচ্ছে, হবে। তাই সাহিত্যের মাধ্যমেই আমরা যেমন পূর্বকালের সমাজের মানুষের জীবনাচার সম্পর্কে জানাতে পারি তেমনি বর্তমান সময়ে রচিত সাহিত্যের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের সমাজকে চিনতে পারবে, জানতে পারবে। আয়নার দিকে তাকালে আমরা যেমন নিজেকে দেখতে পাই, তেমনি সাহিত্যের দিকে তাকালে সে সমাজের মানুষের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, আনন্দ বেদনা, সমাজ, বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মনীতি, রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। সাহিত্যেই উঠে আসে মানবিক মানুষের পরিচয়। সাহিত্যে আমরা পেয়েছি মানুষের কথা, মানবিকতার কথা “সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।” সাহিত্য সমাজের কথা বলে, সাহিত্য সমাজের ছবি আঁকে। সমাজ ছবির মতোই সুন্দর হয়ে দেখা দেয় সাহিত্যে। ড. লুৎফর রহমান বলেছেন- “কোন সভ্য জাতিকে অসভ্য করার ইচ্ছা যদি থাকে তাহলে তাদের বইগুলো ধ্বংস করে দাও এবং কোন দেশকে সভ্য ও মানুষ করবার বাসনা থাকে তাহলে সে দেশের সাহিত্যকে উন্নত কর।”

সামাজিক আচার, রীতি-নীতি নিয়ত পরিবর্তনশীল। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে একটি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান রয়েছে। একটি নিষিদ্ধ আচার, অপরটি চিহ্ন বা প্রথা। মানুষের মধ্যে সৌহার্দতা, সহমর্মিতা, ভালোবাসার পাশাপাশি ঘৃণা, লোভ, জিঘাংসা পরিপূরকভাবে অবস্থান করে। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে আচার-আচরণ নিয়ম-নীতি প্রবর্তন করেছে। আজকের সমাজ যেমন আছে হাজার বছর পরে তেমন থাকবে না। সমাজের সমসাময়িককালের বিষয় নিয়েই সাহিত্য রচিত হয়। হয়তোবা শতবর্ষ পরে সেই সমাজের আচার তেমনটি থাকবে না। তখন আজকের সমাজের আচার নিয়ম নীতি আগামী প্রজন্মের মানুষ সাহিত্য থেকে খুঁজে নেবে। যেমনিভাবে আজকের আমরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের পদগুলো পর্যালোচনা করে তৎকালীন বাঙালি সমাজের আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে জানতে পেরেছি। চর্যাপদের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি তখনকার মানুষ পাহাড়ে বসবাস করত, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উপরণ তারা নিজ হাতে প্রস্তুত করত, ছেলেরা পশু পালন করতো, মেয়েরা ময়ুর পুচ্ছ, গুঞ্জর মালা পরিধান করত। বিয়ে শাদি হতো, ঢাক-ঢোল বাজিয়ে কনেকে ঘরে তুলে নিতো, সে সমাজেও যৌতুক প্রথা প্রচলিত ছিল। কবির কবিতায়- “উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি বসই সবরী বালী, মোরাঙ্গ প্চ্ছু পরিহাণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।”

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের “অন্নদামঙ্গল” কাব্যের অন্যতম চরিত্র ঈশ্বরী পাটুনির জবানীতে বিখ্যাত উক্তিতে আমরা দেখি মানবিক মানুষের প্রতিচ্ছবি- “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”। এখানে সন্তান বলতে মানুষকেই বোঝানো হয়েছে। ঈশ্বরী পাটুনির এই উক্তি সর্বকালের সর্বজনীন চিন্তার প্রতিচ্ছবি। চর্যাপদ আবিষ্কার না হলে হয়তো আমরা সে সময়ের সমাজ ব্যবস্থার পরিচয়ই পেতাম না। আজকের সমাজ এই সময়ের সাহিত্যের প্রতিটি বর্ণমালায় ছবি হয়ে আঁকা থাকবে।

ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *