মন ঘর
মন ঘর
আবু নেসার শাহীন
সকাল বেলা । অনেক দূর থেকে হুইসেল দিতে দিতে একটা ট্রেন এসে থামে। রহমান আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানায় ওঠে বসে । বালিশের তলা থেকে চশমা নিয়ে পড়ে । ঘড়ি দেখে চমকে ওঠে । সর্বনাশ? আটটা বেজে দশ মিনিট ।সে নাস্তা সেরে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়।বাস স্ট্যান্ডে এসে মতিঝিলের বাসে চেপে বসে । সবাই মাস্ক পড়ে আছে । সে সিটে বসে ঘুমিয়ে পড়ে । এয়ারপোর্ট স্টেশনে এসে ব্রেক কষে বাস থামে । তার ঘুম ভেঙে যায়। লোকজন চেঁচামেচি করে । গালাগাল করে কেউ কেউ ।
বোরকা পরা একটা মহিলা তার পাশে বসে বলল, একটু চেপে বসেন। আর না হলে আমাকে জানালার পাশে বসতে দিন। আচ্ছা আপনি কোথায় যাবেন?
মতিঝিল । আপনি?
সে মহিলাকে জানালার পাশে বসতে দেয়। আমার ঠিক নেই । যে কোন জায়গাতেই নেমে পড়তে পারি। স্বামী পলাতক। মাথা ঠিক নেই।
আপনার বৌ আছে?
আছে । কিন্তু —-।
কিন্তু কি? ইদানিং আপনি একা থাকছেন । আপনার বৌ ছেলে মেয়েরা আপনাকে মিস করছে। আপনি তাদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন না, তাই না?
আপনি জানেন কিভাবে? সে খুব অবাক হয়।
আমি মুখ দেখে সব বলে দিতে পারি । আপনার সম্পর্কে আরও কিছু বলবো?
না । খুব ঘুম পাচ্ছে । বাস মতিঝিল পর্যন্ত আসলে একটু ডেকে দিয়েন। এ কথা বলে সে চোখ বুঝে । এবং কিছুক্ষণের ভেতর ঘুমিয়ে যায়। বিকট শব্দে নাক ডাকে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ে । সে দুই হাত বুকের ওপর রেখে সিটে হেলান দিয়ে এক চোট ঘুমিয়ে নিয়ে ওঠে দেখে মহিলা তার কাধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে । অদ্ভুত ব্যাপার! সে নিচু গলায় বলল, হ্যালো । হ্যালো । প্লিজ একটু সরে ঘুমান।
কনট্রাকটর ছুটে এসে মহিলাটাকে জাগিয়ে তুলে। মহিলা তার একটা হাত চেপে ধরে । সে হতচকিয়ে যায়। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পিছনে একটা সিটে গিয়ে বসে । কিছুক্ষণ পর মহিলা ও তার পাশে গিয়ে বসে । বাস তখন বনানী বাস স্ট্যান্ড । মহিলা বলল,রহমান সত্যি তুমি আমাকে চিনতে পারছো না? বার বছর তুমি আমার সাথে সংসার করেছো। আজ তিন বছর হল তুমি নিরুদ্দেশ । আমার কথা না হলে বাদই দিলাম । কিন্তু তোমার ছেলে মেয়ে, তারা কি দোষ করেছে?
কে! কুলসুম? সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ।
কুলসুম মাথার কাপড় খুলে ফুপিয় কাঁদে। যাত্রীদের ভেতর থেকে কেউ কেউ তাকায় । সে বিরক্ত বোধ করে । কেমন যেন একটা অসস্তি লাগে । সত্যি তিন বছর হল সে একা থাকে । পরিবারের খবর ও নেয় না। আসলে তার বউ ছেলে মেয়ে সংসার ভালোলাগে না । একা থাকতে, একা পাক করে খেতে ভালোলাগে । সংসার এক অদ্ভুত জায়গা ।সারাক্ষণ সবাইকে কিছু না কিছু দিতে হয়। সবাইকে দিতে দিতে নিজের জন্য আর কিছুই থাকে না । নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হয়। অথচ অল্প কয়দিনের জীবন । কুলসুম বলল, চল আজ আমার সাথে বাড়ি ফিরে যাবে । ছেলে মেয়েরা তোমাকে ফেলে খুব খুশি হবে । এই যে তাদের জন্য এতো কিছু করি । সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খেঁটে মরি । তুমি তাদের অবহেলা কর। তাদের ছেড়ে দ‚রে দ‚রে থাকো। তারপর ও তারা তোমাকে ভালোবাসে। তাদের সামনে তোমার সম্পর্কে একটা ও বাজে কথা বলা যায় না । সবাই এক সাথে আমাকে ধরে ।
তারা আমাকে ভালোবাসে। সেটা খুব স্বাভাবিক । সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।
তাহলে আজ আমার সাথে চল । তোমাকে না নিয়ে আমি যাবো না ।
আচ্ছা আমার খোঁজ ফেলে কি করে? আমিতো কাউকে আমার ঠিকানা দেই না ।
সেটা না হয় পরে বলবো। না যেতে চাইলে চিৎকার করে লোকজন জড়ো করবো। এমন অবস্থা করবো –।
বাস মহাখালী স্ট্যান্ডে। সে মনে মনে সাত পাঁচ ভাবে । একবার ভাবে বাস থেকে নেমে কুলসুমকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করবে। হালকা কিছু খাবে। তারপর সুযোগ মতো কেঁটে পড়বে । মনে হচ্ছে কুলসুম তার বাসা এবং অফিস দুটোই চিনে। আপাতত সে রকম মনে হচ্ছে । সে বলল,আজ তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি বেতন পেয়ে বাড়ি যাবো।
হি হি হি । তুমি আমাকে বোকা ভাবছো না ? তুমি এ রকম কেন? তোমার বউয়ের দরকার নেই ? এ কুলসুম সুন্দরীর পিছনে এখন ও কত লোক ঘুরে ।
কাউকে বাও করেছো নাকি? সে ও হাসে ।
না । সে রকম মেয়ে হলে কবেই তোমাকে ছেড়ে চলে যেতাম ।
তা ঠিক । সে কুলসুমের হাত ধরে আবার ছেড়ে দেয়।কুলসুম চোখ মুছে । বাস সাত রাস্তা পার হওয়ার আগে একচোট বৃষ্টি হয়ে গেছে । রাস্তা বন্ধ । একটা মিছিল ট্রাক স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে বলল,বাড়ির সবাই ভালো?
ভালো । নারান্দিয়া আর জাগজোর মধ্যে ডাকাতিয়া নদীর ওপর ব্রিজ হয়েছে। গ্রামের সব রাস্তা ঘাট পাকা হয়েছে। মানুষ একটার পর একটা বিল্ডিং করছে । গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছে। পুলের কাছে মোস্তফা কামাল বিশ্ববিদ্যালয় করছেন । আমাদের কবর স্থানের কাছে নতুন থানা হয়েছে । সবকিছু বদলে যাচ্ছে । শুধু তুমি আগের মতো ।
হা হা হা । ভালই বলেছো। সে মানি ব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার পাঁচটা নোট বের করে কুলসুমের হাতে দেয়। কুলসুম টাকাটা রহমানের হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, প্রতি মাসে বিশ পঁচিশ হাজার টাকা খরচ হয়। আমার ছেলে মেয়েরা কত কষ্ট করে চাকরি করে সংসার চালায়। আর তুমি? ভালো বেতন পাও। ভাল ভাল খাবার খাও। সত্যি তোমার আমাদের কথা মনে পড়ে না ? সত্যি আমরা এতো খারাপ ? কী করে থাকো? আমিতো আমার ছেলে মেয়েদের ছাড়া থাকতে পারি না । তারা আমার আত্মা। ওরা আমাকে ভালোবাসে না ? সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এটা তোমার ভুল ধারণা । ওরা আমার চেয়ে তোমাকে বেশি ভালবাসে ।
কচু ।
আজ আর তোমার অফিস যাওয়া হবে না । কুলসুম ফোন করে ছেলে মেয়েদের রহমান বাড়ি আসার কথা জানিয়ে দেয়।
দুই
জাগজোর গ্রামের ব্যাপারী বাড়ি। সন্ধ্যে বেলা । চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে । রহমান বাড়ি আসার খবর পেয়ে তার ভাই বোন ও আত্মীয় স্বজনেরা ছুটে আসে । বড় ছেলে করিম বাবুর্চি ডেকে মোরগ পোলাও পাক করেছে। সবার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক । তবে খাওয়া শেষ হলে কেউ আর থাকছে না । যে যার মতো করে চলে যাচ্ছে । এক সময় রাত বাড়ে । সবাই ঘুমিয়ে পড়ে । শুধু জেগে থাকে রহমান আর কুলসুম । বাড়ির সামনে নেড়ি কুকুরটা গেউ গেউ করে যাচ্ছে । কুলসুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচু গলায় বলল, এতো সুখ কোথায় পাবে? আপনজন ছাড়া কিভাবে থােেকা ? ছেলে মেয়েরা তোমাকে পেয়ে কত খুশি । কুলসুম কাঁদে । ডুকরে কাঁদে । গভীর রােেত তার কান্নার শব্দ শুনে ছেলে মেয়েরা চুপচাপ চোখ বুজে পড়ে থাকে। রহমান নিচু গলায় বলল, আর তোমাদের ছেড়ে যাবো না । সত্যি বলছি । এ আল্লাহর কসম ।
তুমি এ রকম অনেক বার কসম খেয়ে বলেছো। কিন্তু -।
এবার সত্যি বলছি । এবার তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।
ঠিক আছে বিশ্বাস করলাম । এবার তুমি যদি আমাদের ছেড়ে চলে যাও।তাহলে আমি ও যেদিকে মন চায় সেদিকে চলে যাবো । তোমার ছেলে মেয়েদের দেখ ভাল করার আমার কি দায় পড়েছে?
না না এ কথা বলো না । এভাবে কথা চলতে থাকে । মান অভিমানের পালা শেষ হলে একজন আরেক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে। এক সময় ঝগড়া বাঁধে। হাতাহাতি,মারামারি করে । এ ঝগড়ায় যোগ দেয় ছেলে মেয়েরা ও। সকাল বেলা গ্রামের মানুষ ডেকে শালিস বসে । এক সপ্তাহ পর বাজারে যাওয়ার কথা বলে আবার ও নিরুদ্দেশ হয় রহমান ।