ধূম্রজাল
ধূম্রজাল
শেখ মোঃ আকিব হোসেন (সিফাত)
এখন সময় সকাল ৯:০০ টা। আমি ও ইমরান ভাই বসে আছি টিএসসি এর একটি চা- এর দোকানে। আমাদের দুজনের হাতেই চা। আমি চায়ের সাথে সিগারেটও খাচ্ছি। ইমরান ভাই আর আমি কথা বলছি ও উপভোগ করছি প্রকৃতি কারণ আমাদের এই ঢাকা শহরে যেখানেই চোখ যায় সেখানেই উঁচু উঁচু দালান আর গাড়ির শব্দ কিন্তু টিএসসি এলাকাটা একটু ভিন্ন। এখানে উঁচু দালান আছে তবে গাছপালাও প্রচুর। এখানে গাড়ির শব্দ প্রায়ই নেই। তাই অবসর সময়ে আমি এখানে এসে বসে থাকি এবং চা আর সিগারেট খাই ও মনের কথা গুলো শেয়ার করি ইমরান ভাইয়ের সাথে। রোজ কম হলেও ১২-১৫ টা সিগারেট আমার লাগেই আর ঘুরতে গেলে বা বন্ধুদের সাথে আড্ডার সময় ও মন খারাপ এর সময় ২-৩ প্যাকেট ও কম হয়।
যাই হোক ইমরান ভাইয়ের সাথে টিএসসিতে বসে আছি কারণ আজ আমার মন খারাপ আর মন খারাপ হলে আমি চা আর সিগারেট খাই প্রচুর তা আমি একটু আগেও বলেছি। ইমরান ভাই হলেন আমার খালাতো ভাই। তিনি আমার থেকে বয়সে বড় হলেও আমি আর ইমরান ভাই এমন ভাবে চলাফেরা করি যেকেউ আমাদের বন্ধু মনে করে।
ইমরান ভাই আমার থেকে সাত বছরের বড়। আমার ভালো, মন্দ, মন খারাপ, খুশি সকল বিষয়ে ইমরান ভাই আমার পাশে থেকেছেন আজও তাই তিনি আমার পাশে আছেন। আমার বড় ভাই ও বন্ধু বলতে ইমরান ভাই। তাছাড়া কলেজের বন্ধুরাও আছে কিন্তু আমি তাদের সাথে তেমন ভাবে মিসি না। সিগারেট আমার সুখ, দুঃখের সঙ্গী হয়ে গেছে বলা যায়। ইমরান ভাই আমাকে অনেক ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেন আমি যাতে সিগারেট কমিয়ে দেই বা ছেড়ে দেই। কিন্তু সিগারেট খাওয়া আমার অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। আমি সিগারেট ছাড়া চলতেই পারি না।
আমি সিগারেট খাই বলে আপনারা আবার মনে করবেন না যে, লুতফুর চৌধুরীর ছেলে ফারদিন চৌধুরী অন্যান্য নেশার সাথেও জড়িত। না আমি অন্যান্য কোনো প্রকার নেশা করি না। কেবল সিগারেট খাই আমি।
যাই হোক এতো কথা বললাম আপনাদের কিন্তু নিজের পরিচয় দেয়া হলো না।
আমি ফারদিন চৌধুরী। বাবা-মা এর একমাত্র ছেলে। আমার বাবাকে চিনে না এমন কেউ নেই।
উনি স্বনামধন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন। আমি স্ট্যামফোর্ড কলেজের ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ছোট থেকে বড় হই রাজপুত্রের মতো আদর যত্নে কিন্তু দুই বছর আগে আমাদের সকল সম্পদ আমার চাচা আত্মসাৎ করে। এবং আমাদের নানা ধরনের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। আমরা নতুন করে আগাতে গেলেই আমাদের ক্ষতি করে আগাতে দেয় না। আইনের আশ্রয় নিয়েও লাভ হচ্ছে না। কথায় আছে না, “টাকা যার ক্ষমতা তার”।
টাকা কথা বলে। এই কথাটা একেবারে বাস্তব।
যার কাছে টাকা আছে সে খারাপ হলেও ভালো হয়ে যায়। মানুষ তার সুনাম করা শুরু করে দেয় টাকার লোভে। এই দুনিয়ায় সবাই স্বার্থপর।
আপন কেউ নেই।
তাই তো বড় বড় লেখক ও মনিষীরা বলেছেন জীবনে সাফল্য অর্জন করতে হলে নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করতে নেই।
চিন্তায় চিন্তায় ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন বাবা। পড়াশোনা বন্ধ করে পরিবারের হাল ধরতে হয় আমাকে। সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার পরে, আমাদের উপর চাচার পক্ষ থেকে করা নানান রকম ক্ষতি, বাধা বিপত্তির পরেও বাবা ঋণ নিয়ে, ছোট একটি ভাড়ার দোকানে ব্যাবসা শুরু করেন নতুন করে। আমি বর্তমানে বাবার ব্যাবসা দেখাশোনা করি।
কলেজ পড়ুয়া ছেলে থেকে দোকানদার অর্থাৎ ব্যাবসায়ী হয়ে গেছি। পারিবারিক, ব্যাবসায়িক ও চাচার নানা ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতে আমি ভেঙে গেছি ভেতর থেকে। ভেঙে গিয়েও প্রতিটি বার নিজেকে বার বার শক্ত করে এগিয়ে যাচ্ছি। এভাবে আর কত দিন চলবে? কতদিন আমাদের ক্ষতি করবে মানুষ? আর এসব ভেবে ভেবেই আমার মন খারাপ। আজ আমার দোকান বন্ধ। আজ আমাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সপ্তাহের এই একটি দিন পাই নিজের জন্য আর তাই আজ সকাল সকাল ইমরান ভাইকে ফোন দিয়ে রেডি হয়ে টিএসসি এর চায়ের দোকানে আসতে বললাম।
আমি আমার মনের সব কথাই ইমরান ভাইকে বলি। বড় ভাই ও বন্ধু হিসেবে সব সময়, সকল সুখ, দুঃখ, বিপদ, আপদে ইমরান ভাই আমার পাশে থেকেছেন আর আমাকে সাহস দিয়েছেন।
কারণ আমার প্রাতিষ্ঠানিক যে সকল বন্ধু আছে তারা অহংকার, হিংসা, একে অপরের নিন্দা, নিয়েই ব্যাস্ত এই কারণে আমি তাদের সাথে মিসি না।
তাই নিজের মনের ভেতর জমানো ব্যাথা, কষ্ট, হাসি, কান্নার সকল কথা ও পরামর্শ নিতে এবং সময় কাটাতে ইমরান ভাইকে ডাকা। আর আমার ফোন পেয়ে ইমরান ভাইও সাথে সাথে চলে এসেছেন, তাই নিজের মনের কথা গুলো বলছি উনার সাথে বসে সিগারেট ও চা খাচ্ছি।
তারপর ইমরান ভাইয়ের সাথে সারাদিন এভাবেই ঘুরাঘুরি করে দিন পার করে ঘরে ফিরলাম আর চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পরলাম। কারণ সকালে আবার প্রতিদিনের মতো দোকান যেতে হবে।
এভাবেই চলতে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সাথে চলতে থাকে আমার সিগারেট খাওয়া। হঠাৎ করেই জীবনটা উলোটপালোট হয়ে গেছে। সম্পদ হারানোর ফলে চিনতে পেরেছি মানুষের রুপ, আচরণ, প্রকৃত বন্ধু ও অভিনয়কারীদের মধ্যে পার্থক্য। পেয়েছি স্বার্থপর মানুষের পরিচয় এবং নিষ্ঠুর জগতের পরিচয়। জীবন যুদ্ধের এই গল্পে ভালোবাসার মানুষকেও হারিয়ছি কারণ আজ আমি আর আগের মতো ধনী নই। সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে কারণ আগের মতো আমার ধনদৌলত, সম্পদ কিছুই নেই। তখন বুঝতে পেরেছিলাম সে আমাকে নয়, সে পছন্দ করতো আমার বাবার সম্পদ কে যার ভবিষ্যৎ মালিক আমি। কারণ আমি আমার বাবা একমাত্র ছেলে সন্তান। সেই কষ্টটাও চাপা আছে বুকের বা পাশে মনের ছোট ঘরে।
আমি প্রায় মাঝ রাতে কান্না করি লুকিয়ে লুকিয়ে কারণ ছেলেদের নাকি কান্না করতে নেই আর চিন্তা করি মনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের। আমাদের এই মন খুবই অদ্ভুত, এটা ছোট হলেও এর ভেতর থাকা জায়গা সীমাহীন। এই মন নিজের ভেতর অজস্র কথা, ব্যাথা, কান্না ও সুখ সব কিছুই জমা করে রাখতে পারে।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে জীবন গল্পের সাতটি বছর। কলেজে আমার সাথে যারা ছিলো তারা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে কেউ ব্যাবসা ও কেউ চাকরি করে আজ ভালো পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
কিন্তু আমি আছি সেই আগের মতো ভেজাল এর ভেতর। চাচার সাথে এখন উনার ছেলে অর্থাৎ আমার চাচাতো ভাইও আমাদের পেছেনে লেগে আছে। তারা চায় না আমরা ভালো থাকি, তাই সব সময় আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে আর আমি সেই চেষ্টাকে সফল হতে দেই না।
আজ আমার তেমন সম্পদ নেই কিন্তু যতটুকু আছে তাতে আমি সন্তুষ্ট। জীবন কাটানোর জন্য যতটা প্রয়োজন ততোটা সম্পদ ও টাকা আমার আছে।
বাবাও প্রায় সুস্থ। আপনারা বলতে পারেন আল্লাহ আমাদেরকে ভালো রেখেছেন। অনেক দিন পর আমরা পুরো পরিবার ও আমার খালার পরিবার মিলে ঘুরতে যাচ্ছি ঢাকার বাইরে সিলেটে। আজ রাত ১০:৩০ মিনিটে শ্যামলী থেকে বাস ছাড়বে আমাদের। সবাই ব্যাগ গুছানো নিয়ে ব্যাস্ত।
আমি আর ইমরান ভাই বাসার ছাদে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কথা বলছি। হঠাৎ করে আমার অস্থির লাগছে। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তারপর কি হয়েছে আমার জানা নেই। আমি হয়তো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। যখন আমার জ্ঞান ফিরল নিজেকে আবিষ্কার করলাম পপুলার হাসপাতালের বিছানায়। হাতে স্যালাইন লাগানো। চারপাশে আমার আত্মীয়রা। কি হয়েছে আমার বুঝে উঠার আগেই নার্স ও ডাক্তার এসে আমাকে দেখলেন তারপর আমাকে পাঠানো হলো টেস্টের জন্য। টেস্ট করে আবার আমাকে কেবিনে আমার বিছানায় শুইয়ে দেয়া হলো। কাল সকালে রিপোর্ট আসবে। আমার এই অসুস্থতার জন্য সবার ঘুরতে যাওয়া হলো না। অপরাধী লাগছে নিজেকে। আম্মু আব্বু আমাকে এই অবস্থায় দেখে কান্না করতে করতে ভেঙে পরেছেন পুরো। ইমরান ভাই আম্মু আব্বুকে সান্ত্বনা দিয়ে আমার কিছু হয়নি আর হবে না বুঝিয়ে বাসায় পাঠালেন।
আমার সাথে একজন থাকতে পারবে হাসপাতালে তাই ইমরান ভাই থাকলেন।
কেটে গেলো রাত সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো। ইমরান ভাইকে ডেকে বললাম ওয়াসরুমে যাবো। ইমরান ভাই আমাকে ধরে ওয়াসরুমে নিয়ে গেলেন। ফ্রেশ হয়ে আবার বিছানায় এসে বসে রইলাম ইমরান ভাইয়ের সাহায্যে। নার্স এসে আমার ব্লাড প্রেশার দেখলেন ও ঔষধ খাইয়ে দিলেন ডাক্তার আসবে কিছুক্ষণ পরে আমার রিপোর্ট ও চলে এসেছে ইতিমধ্যে। ইমরান ভাই পাশে বসে আছেন আর আম্মুও নাস্তা নিয়ে এসেছেন। আম্মু আমাকে দেখেই আবার কান্না করে দিলেন। তারপর আমাকে দোয়া দিতে লাগলেন। তখনই ডাক্তার এসে জিজ্ঞেস করলেন
ডাক্তার: “কেমন লাগছে ফারদিন সাহেব”?
আমি: জ্বি স্যার ভালো।
ডাক্তার: ঘুম হয়েছে ঠিক মতো?
আমি: জ্বি স্যার।
ডাক্তার: গলায় কোনো প্রকার ব্যাথা আছে?
আমি: জ্বি।
ডাক্তার: কাশি কি বেশি?
আমি: জ্বি।
ডাক্তার: মুখ থেকে কাশের সাহায্যে রক্ত বেরিয়েছে?
আমি: গলা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম।
তারপর ডাক্তার আমার রিপোর্ট দেখে ইমরান ভাইকে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন।
তখনই কেমন যেন একটা খটকা লাগলো মনে। কি হয়েছে আমার? কেনো রিপোর্ট দেখার পর ডাক্তার আমাকে কিছু না বলে ইমরান ভাইকে বাইরে ডেকেছেন? এই রকম হাজার প্রশ্ন ঘর বাধছে মনে।
ইমরান ভাই যখন ডাক্তার এর কাছ থেকে হয়ে আমার কাছে আসলেন তখন উনার মুখ ছিলো ভার ভার, কান্না কান্না চোখ
আমি ইমরান ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম ভাইয়া কি হয়েছে ডাক্তার কি বললেন? কি এসেছে রিপোর্টে আমার?
আমার এই সব প্রশ্ন শুনে তিনি চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করলেন আর বললেন “না তেমন কিছুই না। তুই ঠিক হয়ে যাবি। ভাই তুই সিগারেট ছেড়ে দে। কথা দে আর কখনো সিগারেট খাবি না”।
ইমরান ভাই এই কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বললেন আর আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।
আমি ইমরান ভাইয়ের এরকম আচরণ দেখে বুঝে গেছি আমার নিশ্চিত এমন কিছু হয়েছে যা ভয়াবহ। তারপর ইমরান ভাই আম্মুকে বললেন বাসায় যেতে। আম্মুও জিজ্ঞেস করলেন কি বললো ডাক্তার কিন্তু ইমরান ভাই বললেন তেমন কিছু হয়নি আপনি বাসায় জান।
আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে চলে গেলেন।
ইমরান ভাইকে অনেক করে জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারি আমার গলায় ক্যান্সার হয়েছে অতিরিক্ত সিগারেট খাওয়ার ফলে। আমার অপারেশন করা লাগবে। এই অপারেশন এর ফলে হয় বেঁচে থাকবো আর না হয় বিদায় জানিয়ে চলে যেতে হবে পৃথিবীর সকল কিছুকে।
আর অপারেশন যতদ্রুত সম্ভব করা লাগবে তাই ইমরান ভাই আমাকে বললেন ভাই তুই চিন্তা করিস না। আল্লাহ আছেন।
সুস্থ হয়ে যাবি তুই একদম চিন্তা করিস না। এই কথা গুলো বলে চলে গেলেন হাসপাতালের কেবন থেকে আর আমি একা একা বসে ভাবতে থাকলাম কি হবে আমার পরিবারের যদি আমার কিছু হয়ে যায়? আম্মু-আব্বু নিজেকে সামাল দিতে পারবেন তো?
ইমরান ভাই আমার বাসায় গিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে শান্ত করে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। আজ রাত ১১:০০ টায় আমার অপারেশন। আর এখন সময় রাত ৯:৩০ মিনিট।
ওয়ার্ড বয় আমাকে ওটির জামা পড়িয়ে রেডি করে নিয়ে যাচ্ছে অপারেশন থিয়েটারে। জানি না আমি আর জীবিত অবস্থায় ফিরবো কি না, সবাইকে আবার দেখবো কি না জানি না।
তাই আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে নিলাম, আব্বুর চেহারা বার বার চোখে ভাসছে। আব্বু জানে না আমার কি হয়েছে আর আমার আজ অপারেশন। নিজেকে শান্ত করে আম্মু ও সবার কাছে মাফ চেয়ে, দোয়া নিয়ে, সবাইকে বিদায় জানিয়ে চললাম অপারেশন এর উদ্দেশ্যে। অপারেশন চললো ৩ ঘন্টা। অপারেশন এর সময় ৪ বা ৫ জন রক্তদাতার প্রয়োজন হতে পারে জানিয়েছিলেন ডাক্তার সাহেব। কিন্তু আমার যে রক্তের গ্রুপ তা সহজে পাওয়া যায় না। তাও ইমরান ভাই এই অল্প সময়ের মধ্যে (A-) এ নেগেটিভ রক্তের ২জনকে রক্তদানের জন্য খুজে বের করে সাথে রাখেন। অপারেশন শেষ হয় সফল ভাবেই। সকলের দোয়া কবুল হয় কারণ ডাক্তার ৪ থেকে ৫ জন রক্তদাতাকে জোগাড় করে রাখতে বলেছিলেন কিন্তু তার আর প্রয়োজন হয়নি। দুজনের রক্ত দিয়েই হয়ে যায়। অপারেশন শেষে ডাক্তার বেরিয়ে আসেন তখন সবাই আমার খোঁজ নেয়ার জন্য ডাক্তারের কাছে জান আর আমার কথা জিজ্ঞেস করায় ডাক্তার বলেন অপারেশন সফল হয়েছে কিন্তু জ্ঞ্যান না আসার আগ পর্যন্ত কিছু বলা সম্ভব না। এটা শুনে আম্মু কান্না করতে থাকলেন তখন ইমরান ভাই আম্মুকে সাহস দিয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেন কত সময়ে জ্ঞান ফিরতে পারে। ডাক্তার বলেন ৭২ ঘন্টা। অপারেশন শেষে আমাকে রাখা হয় আইসিইউ তে, লাইফ সাপোর্টে। সবার উপর আবার ভয় ও দুঃখের আবহাওয়া নেমে এলো। সবাই আমার জ্ঞান ফেরার দোয়া করছে। আমার জ্ঞ্যন ফেরার অপেক্ষায় কেটে গেলো ৭২ ঘন্টা কিন্তু আমার জ্ঞান ফিরেনি। ডাক্তার এর সাথে কথা বলেন ইমরান ভাই কিন্তু তিনি জানান তার হাতেও কিছু নেই করার মতো। সব এখন আল্লাহর হাতে তিনি চাইলেই আমার জ্ঞান ফিরবে। আর ডাক্তারদের যা যা করণীয় আছে তা তারা চেষ্টা করে যাচ্ছে। ১৫ দিনের কেটে যায় আরো এভাবেই কিন্তু জ্ঞান ফেরার নাম নেই। অনেক টাকা খরচের পর, উন্নত চিকিৎসা ও অসংখ্য দোয়ার ফলে ২২ দিন পর জ্ঞান ফিরে আমার।
আর এই ২২ দিনের মাঝে ঘটে যায় অনেক কিছু। আমার জ্ঞান ফেরার পর দুই দিন আরো রাখা হয় আইসিউ তে অব্জার্ভ এর জন্য। তারপর একদিন পিআইসিইউ তে রেখে পর দিন আমাকে ডিসচার্জ করে দেন ডাক্তার। এর মাঝে আমার সাথে কেউ দেখা করতে পারেনি। জীবন ও মৃত্যুর সাথে সংগ্রাম করে জয়ি হয়েছি আমি। আমার মতো এমন কপাল সবার হয় না আমি মনে করি। এটা আমার মা বাবা ও আমাকে আপন ভাবে তাদের দোয়া যে আজ আমি বেচে আছি। আমার ডিসচার্জ এর খবর পেয়ে ইমরান ভাই ও আম্মু দ্রুত ছুটে আসেন আমার সাথে দেখা করতে। আমাকে দেখা মাত্রই আম্মু ও ইমরান ভাইয়ের চোখ থেকে অঝোরে কান্না ঝরছে। আম্মু এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে সমানে আমার মাথায় হাত বুলাতে থাকলে আর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে থাকলেন অনেকক্ষণ। আমার কথা বলা সম্পুর্ন নিষেধ তাই আমি আম্মুকে শান্ত করার জন্য ইশারায় বললাম: আম্মু কান্না করতে হয় না। হয়েছে এবার কান্না থামাও কিছু হয়নি আমার আর হবেও না কিছু। তোমরা থাকতে আমার কি কিছু হতে পারে? পারে না।
আম্মু তাও কান্না করছেন পরে ইমরান ভাই আম্মুকে শান্ত করে বললেন,
ইমরান ভাই: খালা হয়েছে কান্না থামান। এখন কান্নার সময় না। এখন খুশির সময়। আমাদের ফারদিন সুস্থ হয়ে গেছে আর আমাদের সাথে বাসায় যাবে এখন। ইমরান ভাই হয়তো আমার ইশারায় কথা বলা বুঝতে পেরেছেন আমি কি বলতে চাচ্ছি।
ইমরান ভাইয়ের কথা শুনে আম্মু একটু হেসে বলেন হ্যাঁ বাবা ঠিক বলেছ তুমি। তারপর ইমরান ভাই আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন তুই থাক আমি আসছি ফরমালিটি সব পূরণ করে।
তারপর আম্মু আর ইমরান ভাই চলে গেলেন এক ঘন্টার মতো সময় অতিক্রম করার পর আম্মু আর ইমরান ভাই আবার এলেন আর আমাকে বাসায় নিয়ে যেতে। এম্বুল্যান্সে করে বাসায় পৌছালাম। এবং অনেক আরাম ও আদর যত্নের মধ্যে দিয়ে কেটে গেছে আরো একটি মাস। এখন আমি অনেকটা সুস্থ। আজ ডাক্তার দেখিয়ে এসেছি। ডাক্তার বলেছেন আমি মোটামুটি সুস্থ তবে আরো আরাম করা ও নিজের যত্ন নেয়া প্রয়োজন। এটা শোনার পর ডাক্তারকে দোকানে যেতে পারবো কি না কথাটা জিজ্ঞেস করলে ডাক্তার বলেন আমি দোকান যেতে পারবো কিন্তু যতটা সম্ভব কম কথা বলতে হবে তাহলেই আমি আরো দ্রুত সুস্থ হতে পারবো। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় আসার পর থেকে এই একটা মাস আমি কোথাও যাইনি, দোকানেও না। বাসায় আসার পর থেকে অনেকবার আম্মু ও ইমরান ভাইকে দোকানের কথা জিজ্ঞেস করেছি এমনকি আমার চিকিৎসার জন্য অনেক টাকা লেগেছে যা আমাদের নেই তাই এত টাকা কই থেকে এলো কিভাবে কি হয়েছে জানতে চাইলে উনারা একই কথা বলেন দোকান বন্ধ রয়েছে এবং আমি সুস্থ হই আগে তারপর দোকানে যাবো আর কত টাকা খরচ হয়েছে কই থেকে এসেছে টাকা গুলো এখন এইসব কথা না বলে আরাম করতে। তাই আজ যেহেতু ডাক্তার বলেছে আমি সুস্থ আছি এবং দোকানে যেতে পারবো তাই এবার আর হয়তো আমাকে দোকান যাওয়ায় না করবেন না আম্মু আর ইমরান ভাই। এইসব নানা রকম কথা ভাবতে ভাবতে বাসায় আসি বাসায় এসে আম্মুকে দোকান যাবো, দোকানের চাবি কোথায় জিজ্ঞেস করলে আম্মু বলেন ইমরান ভাইয়ের কাছে আছে। রাতেই আসবেন ইমরান ভাই। এই ভেবে রুমে গিয়ে বসে রইলাম।
রাত ৮টায় আসেন ইমরান ভাই। আমার রুমে এসে আমাকে কেমন আছি জানতে চাওয়া মাত্র আমি ইমরান ভাইয়ের দিকে অনেক গুলো প্রশ্ন ছুড়ে দেই। আমি ইমরান ভাইকে জিজ্ঞেস করি ভাইয়া দোকানে চাবি নাকি তোমার কাছে চাবি দাও সকালে দোকান যাবো তুমিতো সাথেই ছিলে শুনেছ তো ডাক্তার আমাকে দোকান যেতে নিষেধ করেনি। আমি আবার বলি ভাইয়া আমার চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হয়েছে জানি। ক্যান্সার এর ট্রিটমেন্ট এমনিতেই অনেক কস্টলি তার মধ্যে আমি ২২ দিন আইসিইউ -তে ছিলাম সেটার খরচ তো অনেক তাই বলো না কত টাকা খরচ হয়েছে আর সে টাকা গুলো কি করে এলো?
আমার মুখে হঠাৎ করেই এতো গুলো প্রশ্ন শুনে ইমরান ভাই কি বলবেন বুঝতে পারছিলেন না তাই আমাকে একটা ধমক দিয়ে বললেন ডাক্তার না তোকে কম কথা বলেছে? এত কথা বলছিস কেনো? চুপ থাক সময় হলে নিজেই জানতে পারবি সব।
আমি ইমরান ভাইয়ের কাছে ধমক খেয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম তারপর আবার শুরু করলাম জিজ্ঞেস করা। এবার একটু অনুরোধ করে জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু কাজ হলো না। বুঝলাম না তারা আমাকে বলছে না কেনো? তারা আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছে সেটা আমি বুঝতে পারছি কিন্তু সেটা কি তা জানা দরকার কিন্তু কেউ আমাকে বলছে না। আম্মু আর ইমরান ভাইকে খুব কাকুতি মিনতি করার পর চোখের কোনায় পানি ও কান্নার স্বরে আম্মু বললেন বাবা তোর দোকান আর নেই। তুই অসুস্থ হওয়ায় টাকার প্রয়োজনে দোকান ছেড়ে দিতে হয়েছে এমনকি বাসায় যা গহনা ছিলো তাও বিক্রি করা হয়েছে এবং তোর বাবা বন্ধু জাহিদ ভাই থেকে ১০ লক্ষ টাকা ঋন নিয়ে হাসপাতালে ৩০ লক্ষ টাকা জমা দিয়ে তোর চিকিৎসা করিয়েছি। এই বলে আম্মু হু হু করে কান্না করতে লাগলেন। আম্মুর মুখে এই কথা গুলো শুনতে শুনতে আমিও কান্না করেছি কিন্তু নিজের কান্নাকে লুকিয়ে আম্মুকে সান্ত্বনা দিলাম। আম্মু কান্না কোরো না। আমি আবার সব ঠিক করে নিবো আবার আমাদের অবস্থা আগের মতো করে সব ঠিক হয়ে যাবে। আম্মুকে সান্ত্বনা দিয়ে রুমে পাঠালাম ঠিকই কিন্তু আমি নিজেই জানি না কি করে কি করবো। আমরা আবার সেই আগের জায়গায় এসে গেছি। চাচা আমাদের সব সম্পদ আত্মসাৎ করার পর আমরা যে জায়গায় ছিলাম আজ এতটা বছর পর আবার সেই আগের জায়গায় এসে গেছি। আমি ভেঙে গেছি কিন্তু তাও আমার ভেঙে পড়া যে মানায় না। আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে আমাদের অবস্থা আবার ঠিক করতে হবে এমনকি আমার চাচাকে জববাব ও দিতে হবে সাফল্য অর্জন করে। এইসব ভাবতে ভাবতে রাত যে কখনো কেটে গেছে টের পাইনি। সকালে ফজরের নামাজ পড়ে রেডি হয়ে বের হই বাইরে হাটতে থাকি রাস্তায় তখনই মাথায় বুদ্ধি আসে। আর তারপর আমি সোজা ছুটে যাই কালাম ভাইয়ের মোটর গ্যারেজে। কালাম ভাই আমার মোটর সাইকেল কিনতে চেয়েছিলেন যা আমার খুব প্রিয়। কালাম ভাইয়ের সাথে কথা বলে আমি সেটা বিক্রি করে দেই আর সেই টাকা দিয়ে ঢাকা এলিফ্যান্ট রোডে আবারও দোকান নেই ভাড়ায় আর বাকিতে কিছু মালামাল নিয়ে শুরু করি ব্যাবসা। আজ আমার এই দোকানের বয়স ৫ বছর হয়ে গেছে। আল্লাহ পাকের রহমতে এই ৫ বছরে আমি আমার আম্মু গহনা বানিয়ে দিতে, জাহিদ আঙ্কেল থেকে নেয়া ১০ লক্ষ টাকার মধ্যে ৬ লক্ষ টাকা শোধ করতে ও যারা আমাকে বাকিতে মালামাল দিয়ে সাহায্য করেছিলেন তাদের দেনা শোধ করতে সক্ষম হয়েছি শুধু তাই নয়, আমি মিরপুর ১ নাম্বারে একটি দোকান ও ধানমন্ডি ১৫ নাম্বারে একটি ফ্ল্যাটও কিনেছি। আমার আজকের এই অবস্থা দেখে অনেকেই কষ্ট পাচ্ছে কারণ তারা চায় না আমাদের উন্নতি হোক। তারা এই ৫টি বছরে কম চেষ্টা করেনি আমাদের ক্ষতি করার কিন্তু কথায় আছে না, রাখে আল্লাহ তো মারে কে।
তাই, আল্লাহ চাইলে কেউ যতই ক্ষতি করতে চাক না কেনো সাফল্য লাভ হবেই। আল্লাহ পাক আমাকে আজ যা দিয়েছেন যতটা দিয়েছেন তাতেই আলহামদুলিল্লাহ ও অনেক শুকরিয়া কারণ, আজ আমি যা পেয়েছি আর যা আছে আমার, তা অসৎ পথে উপার্জিত না। আজ আল্লাহর হুকুমে আমিও আমার পরিবারের সবাই অনেক ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। এই ৫টি বছরের মধ্যে ইমরান ভাইয়ের বিয়ে ও হয়ে গেছে অনেক আনন্দ করেছিলাম ভাইয়ার বিয়েতে। আজ উনার একটি কন্যা সন্তান ও আছে। আজ আমি প্রতিষ্ঠিত। বেশ ভালো সুনাম রয়েছে সকলের মুখে আমার ব্যাবসার, আমার শোরুমের অর্থাৎ দোকানের।
অপারেশন এর পর থেকে আমার জীবনে অনেক ঝর এসেছে কিন্তু এতে আমি ভেঙে পড়িনি বরং সাহসের সাথে মোকাবেলা করেছি। এই ৫ টি বছরে অনেক দুশ্চিন্তার সম্মুখীন হয়েছি মানুষের আঘাতে আহত হয়েছি কিন্তু নিজের মনোবল ভেঙে যেতে দেইনি আর সিগারেট ও খাইনি কারণ আমার সিগারেট খাওয়ার জন্যই আম্মুকে ঋণ নিতে হয়েছিল জাহিদ আঙ্কেল থেকে, দোকান হারাতে হয়েছিল, গহনা বিক্রি হয়েছিল শুধু তাই নয় আমার জ্ঞান না ফেরার জন্য ফেলতে হয়েছিল চোখের পানি। আর এই চোখের পানি হচ্ছে আমার জন্য অমূল্য সম্পদ। আমার এই কঠিন সংগ্রামের পর জয় লাভের জন্য আজ আম্মু আব্বু অনেক গর্বের সঙ্গে বলেন, নিশ্চয়ই আমরা কোনো মহৎ কাজ করেছিলাম যার জন্য আল্লাহ আমাদেরকে ফারদিনের মতো সোনার ছেলে দিয়েছেন। একটা সন্তানের জন্য এর থেকে বড় জয় ও প্রাপ্তি আর কিছুই হতে পারে না আমি মনে করি। টাকা পয়সা, ধনসম্পদ এগুলো হাতের ময়লার মতো। এগুলো কখনো কারো কাছে চিরস্থায়ী হয়ে থাকে না। আজ আপনার কাছে থাকলে কাল তা অন্যের কাছে থাকবে আবার তা আসবে আপনার কাছে তবে এই সময়ের মধ্যে হবে আপনার কঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষা সয়ং বিধাতা নিয়ে থাকেন। বিধাতা সন্তুষ্ট হলেই আপনি উত্তির্ন। ৬ মাস যাবত আম্মু আব্বু আমাকে বিয়ের জন্য জোর করছেন। আম্মু আব্বু আমাকে বিয়ে করাতে চাচ্ছেন। আমার জন্য উনারা একটি মেয়েও পছন্দ করেছেন। মেয়েটি আর কেউ নয় আব্বুর বন্ধু জাহিদ আঙ্কেলের কনিষ্ঠ কন্যা ইনায়া। এই বছরের শেষে আমারও বিয়ে হয়ে যাবে তাই বিয়ে করার আগে আম্মু আব্বুকে হজ্ব করতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আগামী মাসের ১০ তারিখে আম্মু আব্বুর ফ্লাইট। হাতে বেশি সময় নেই কারণ, আজ মাসের ২৮ তারিখ। আম্মু আব্বুর হজ্বের জন্য যা যা প্রয়োজন তা কেনাকাটা করতে করতে কখন যে সময় অতিক্রম হয়েছে বুঝতেই পারিনি। আজ ১০ তারিখ হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসেছি আম্মু আব্বুকে নিয়ে আমি, ইমরান ভাই, ভাবি ও আমার ছোট ভাতিজী উম্মে সালমা পরী। আজ আমার আম্মু আব্বু হজ্ব করতে যাচ্ছেন তাই আপনারা সকলেও দোয়া করবেন।