অক্টোবর ২৮, ২০২৪

শিক্ষক দিবসে

অরবিন্দ সরকার

ফণীভূষণ হাইস্কুলে শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে। বিশাল হলঘরে দুটি মাইক লাগানো হয়েছে। শিক্ষক মশাইগণ নিজ নিজ চেয়ারে অবস্থান করছেন। অনুষ্ঠানের সভাপতি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শ্রী জনার্দন দত্ত।প্রধান শিক্ষক দেবদুলাল ভট্টাচার্য মশাই বললেন- আজকের দিনটি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন। তিনি শিশু দের খুব ভালো বাসতেন তাই এদিনটি আমরা শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করি।

অনুষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শ্রী জনার্দন দত্ত মশাই বললেন- এই যে হেডমাস্টার, আমি অনুষ্ঠানে সভাপতি। আপনাকে কে বলতে বললো আগে? আমাকে পুতুল বানিয়ে যা ইচ্ছা তাই বলবেন। মিড্ ডে মিলের খাতায় আমি চোখ বুজে সই করে দিই। হিসাব নিকাশের খাতায় চোখ বুজে সই করে দিই। ওখানে আপনার ঘরে একা একাই টিপছাপ দিই। দুখানা বিস্কুট আর এক কাপ চায়ের বদলে। মিড ডে মিলের রাঁধুনি তারা গোটা গোটা ডিম সরিয়ে রেখে যাবার সময় নিয়ে কেটে পরে। আমি চোখে দেখি। যেদিন মাংস হয় সেদিন সব মাষ্টারমশাই খায়। আমাদের কমিটিকে ডাকা হয়না। তাই আজ অনুষ্ঠানে আমি সর্বপ্রথম সভাপতি হিসেবে বলবো, তারপরে নাম ধরে ধরে আমি ডাকবো তারা বলবে! সবার সামনে অপমান আমি হতে পারবো না। আপনার ঘরে কেউ থাকেনা তাই অপমান বোধ করিনা।আর এখানে চুপিচুপি চলবে না। শুনুন গো সবাই- আমি ঠিক বলছি না বেঠিক বলছি। ছাত্র ছাত্রীরা সবাই ফুল ও ফুলের মালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য। এক কোনে রাধাকৃষ্ণনের ছবি রয়েছে।

প্রধান শিক্ষক বললেন- সভাপতি সাহেব আগে মাল্যদান পর্ব শেষ করি, তারপর আপনি বলবেন? সভাপতি জনার্দন দত্ত বললেন- নিশ্চয়ই! আগে সভাপতিকে মালা পরিয়ে বরণ করা হোক তারপর অন্যত্র দেওয়া হোক। আমি জীবিত আর উনি মৃত! বাধ্য হয়ে প্রধান শিক্ষক মশাই একটি মালা উনাকে পরিয়ে দিলেন। জনার্দন দত্ত বললেন কইগো সবাই হাততালি দাও বলে নিজে নিজেই জোর হাততালি দিতে থাকলেন। এর পর সমস্ত ছাত্র ছাত্রী সহ মাষ্টারমশাইগণ রাধাকৃষ্ণনের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন। সভাপতি বললেন- এখন এতো ফুলের মালা বের হচ্ছে? আমার সময় নাই? এতো ফুলের চাপে উনার দম বন্ধ হয়ে যাবে। উনি ঢাকা পরে যাবেন। মৃত লোককে তুলে এনে বিড়ম্বনা! উনি শুনতেও পাচ্ছেন না বরং আমরা সব শুনছি! যতো সব আদিখ্যেতা! যার বিয়ে তার মনে নাই- আর পাড়াপড়শির ঘুম নাই।

পেছন থেকে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ভোম্বল দাস হাততালি দিতে লেগেছে। জনার্দন দত্ত বললেন- কে পেছনে হাততালি দিচ্ছে? ভোম্বল বললো- আমি ভোম্বল দাস এই স্কুলের ছাত্র। জনার্দন দত্ত বললেন- আমি তোমাকে হাততালি দিতে বলেছি? যখন বলবো তখন হাততালি দেবার মুরোদ নাই। এসো দেখি মাইকের সামনে কথা বলতে? এই যে আমি লুকলুক করে বলছি আর ভকভক করে আওয়াজ হচ্ছে , তোমরা সবাই শুনতে পাচ্ছো একে বলে মাইক। হাততালি হাততালি হাততালি! কেউ হাততালি মারার আগেই ভোম্বল দাস মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালো। সবাইকে নমস্কার জানিয়ে শুরু করলো ! আজ শিক্ষক দিবস। শিক্ষকদের দিন হবে না তো কাদের হবে? ছাত্রদের দিবস নাই সব রজনী। তাও আবার অমাবস্যার রাত। শিক্ষক মশাই গন দিদিমনিদের চেয়ারের পাশে বসার জন্য মিউজিক্যাল চেয়ার খেলেন। ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্টাফরুমে পদার্পণ। দৌড় প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে কারো মুখ বেজার। যিনি জায়গা পান তেনার তখন যে ঠ্যাং দুলানি শুরু হয়,যেন এনার্জির জন্য দম লাগাচ্ছেন। টিফিনের সময় টিফিনের মাখামাখি।কার কৌটোর মধ্যে কার কৌটো দৌড়ে বেড়ায়।

স্কুলে আমরা ভাঙা সাইকেল পাচ্ছি বিনিপয়সায়। টাকা দিলে আমরাই পছন্দ করে কিনবো কিন্তু সেগুড়ে বালি। কতো হাত ঘুরে ঘুরে সাইকেলের এই দশা! যেন বুড়া গরু? ঠেলেও একপা চলে না। ঘাড়ে করে নিয়ে গিয়ে কামারশালায় ফেলে সোজা করে আবার সাইকেল মিস্ত্রির বিল মিটিয়ে খাড়া হয় সাইকেল। যন্ত্রনার শেষ নাই? জামাপ্যান্ট দেওয়া হয় ছোটো কিংবা বড়ো! বড়ো হলে বাবা পরে আর ছোটো হলে ভাই। তবুও বিলি করা চাই। সরাসরি টাকার যোগান নাই। সব জায়গায় খাই খাই! কবি ঠিক লিখেছেন সুকুমার রায়। দুপাতা পড়িয়ে মাইনে আবার শেষকালে পেনশন। অভাব ভয়ে পালায়। আর আমাদের ঠাকুরবাবা ঠাকুরমা বাড়ীর বোঝা।সবাই চেয়ে রয় কখন মরবে বুড়ো বুড়ি! আর ইনাদের যত্ন বাড়বে , থাকলে পোয়াবারো- মরলেই আর চড়বে না হাঁড়ি। হালের বলদ গাইগরু বুড়িয়ে গেলে গোয়ালে জায়গা ধরে না,নতুনের আগমনে। ফালতু ওদের দরকার নেই তাই বিক্রি, কসাইখানায় জায়গা ওদের। আমাদের ঠাকুরবাবা ঠাকুরমা তাদের জায়গা সিঁড়ি ঘরে। তারা কখন যে মরে , ডাকে ভগবানেরে। ভুলেও ওদের দিবস পালন হয়না।মড়া মানুষের এখানে আনার কি প্রয়োজন? তার আত্মার চিরশান্তি হয়েছে। আবার মরা ছুঁয়ে স্নান করতে হবে!
জনার্দন দত্ত বললেন– আর না? তুই অনেক বলেছিস? এবার মাষ্টারমশাই তাঁরা বলুক। মাইকের ভাড়া লাগবে। ওরা না বলতে পেলে, ভাড়ার জন্য টিপ ছাপ দিতে হবে আমাকে। তাছাড়া আমাদের চা বিস্কুট কেনা হয়েছে আমাদের খাবার জন্য। আমি দরজার মুখে দাঁড়াচ্ছি তোরা একে একে বের হ লাইন দিয়ে। একটা করে লজেঞ্চুস দেবো , তোরা চুষতে চুষতে বাড়ি যা। সভাপতি সভা ভেঙে দিলেন।

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *