অক্টোবর ২৮, ২০২৪

অস্তিত্ব বিভ্রমের সন্নিকটে

0

এক পা দু’পা করে নির্জন পথ ধরে কোন এক অজানা অস্তিত্বের পিছে এগিয়ে যাচ্ছি। আধো জাগরণে আলো আঁধারির মাঝে। যে পথ ধরে চলেছি তাতে নামফলক আছে, আঁকবাঁকের চিহ্ন আছে কিন্তু সে পথ কোথায় চলে গেছে তা যেন ঠাওর করতে পারছি না মোটেই। আমার নিয়ন্ত্রণহীন পা আমার বারণ সত্ত্বেও আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দূর বহুদূর। পথ ফুরোয় না। দু’পাশে পাহাড় বেষ্টিত জনাকীর্ণ পথ। সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া পাহাড়ি রাস্তা। আমি অনুভূতিহীন হয়ে পথ পাড়ি দিচ্ছি। একবার বজ্র চমকিয়ে বাদল নামালো ক্ষণিকের ভেতরেই। জুবুথুবু হয়ে আমি রণ-ক্লান্তের মতো বসে পড়তে চাইলাম পথিমধ্যে কিন্তু আমার পা দুটোতে আমার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। ভূত জীন বা প্রেত্নাত্নার আছড় পেলে মানুষ এমন হয়। শৈশবের গল্পে এমনসব শুনেছি। আজ তো সব আমার সাথে জীবন্ত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

পাহাড়ি রাস্তার গা বেয়ে দীর্ঘ শূন্যতা। হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি এলে একাকিত্ব চেপে ধরে। ফেলে আসা আবেগ মোহ সবগুলো জড়াজড়ি করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে। হারিয়ে যাবার আর হারানোর সমস্ত উপকরণ নিয়ে হাজির হয় বাতাসে মেঘ। চোখের কোণে অপ্রয়োজনে দুফোঁটা অশ্রু জমে তা বাদল জলে ধুয়ে যায়।
মাঝে মাঝে দুটো একটা কৃষ্ণচূড়া, সৌন্দর্যের পশরা সাজিয়ে বেমালুম অন্যকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

আবেগ অনূভুতির এ বিভ্রমে আসন পেতে বসেছে এক অস্তিত্ব যা দোলাচালে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমাকে। আমার লক্ষ্য নেই, উদ্দেশ্য নেই। নিয়ন্ত্রণহীন এ পথচলার কোন মানেও নেই। উদ্দেশ্যেহীন এ পথ কোথায় গিয়ে মিশেছে, জনে জনে জিজ্ঞাসা করা কেবলই পন্ড্শ্রম।

ভেতরে ভেতরে নিজের মধ্যে একটা দেনদরবার চলছে।
অবচেতনে আসন পেতে বসা সে অস্তিত্বের পরিচয় উন্মোচন কিংবা অবচেতন মনে সে অস্তিত্বের স্বেচ্ছা মুক্তির।
তার জন্য নিজের সাথে দেনদরবার করছি। খুব চেনা কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে, খুব চেনা কিছু শব্দ নতুন করে শুনবার ব্যাকুলতা, স্মৃতির দেয়ালে দেয়ালে আটকানো কিছু ছবি চোখের সামনে ভেসে ভেসে আসছে।

শুরুর জীবনে আমি যে প্রেমিক হতে চেয়েছিলাম তা নয়। প্রেমিকার জন্য শতপদ্ম জোগাড়ে আমার কল্পিত দৃঢ়তা ছিল না, হলুদ গাদার ফুল এনে খোপায় বাঁধবার সাধ-সাধ্যে বেশ ফারাক ছিল। দূরন্ত ষাঁড়ের চোখে লাল কাপড় বাঁধবার মতো সৎসাহসও ছিল না বটে। তাতে আমার আক্ষেপের বালাইও ছিল না। রাস্তার ধারে বকুল, বেলী কিংবা হিজল-হাসনাহেনা আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিচলিত করতো তাদের সৌন্দর্য কুড়িয়ে দুএক লাইন ভেতরে ভেতরে দুলে যেতো। দখিনা বাতাসে কচি কুঁড়ির দোলখাওয়া দৃশ্যের মতো।
আজকালকার ভালোবাসা প্রদর্শন নির্ভর, উপাদেয় সংকুলান না করতে পারলে তা অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। বন্ধুমহলের এসব গালগল্পে মশগুল হওয়ার মতো আগ্রহ ঘিরে ধরেনি কখনও।

দূর অজানার শূন্যতার মতো শত সহস্র মানুষের মাঝে বাস করেও মানুষ চেনার মতো দূর্বোধ্য কাজে আমি বরাবর শূন্য পেয়ে ফেল করেছি। কিছু পুরুষের প্রেমিক হয়ে উঠবার আহবান বনসাই বৃক্ষের মত, খানিক বেড়ে আর বাড়ে না। পত্র পল্লবে জীবন বিকশিত হলেও প্রেমিক হয়ে উঠবার আবদার গহীন অরন্যে শূন্যতার ভীড়ে সীমাহীন চিৎকার করে হাত পাতবার পরও সাহায্যহীন থাকবার নিরন্তর ব্যর্থতা।
মনুষ্য সমাজের বেশিরভাগ অংশই জীবন পার করে যাপন করতে পারে না। যাপিত জীবনবোধের আনন্দ আমাকে ছোঁয় কারো বাহুডোর আবদ্ধ হবার মতো করে। তাতে আনন্দোচ্ছ্বাসের চেয়ে বাস্তবতার ঝাঁপটা বেশি।

পার করা দিনগুলোতে মানুষ কেবলই স্মৃতি আঁকড়িয়ে বাঁচে, যাপিত জীবনের পড়তে পড়তে উপলব্ধির আলিঙ্গন। বহতা নদীর মত যে জীবন বয়ে যায় তা কেবলই ডায়েরির একের পর এক পৃষ্ঠা ফুরোনো গল্প। জীবনকে যাপন করার ইচ্ছেই জাগে রোজ।
জীবন সীমাহীন সমুদ্র নয়। বরং তার ঢেউয়ে ভাসমান এক পাল তোলা নৌকো। স্রোতের বিপরীত বাইতে হয় প্রতিক্ষণে, নোঙর করে জিড়িয়ে নিতে হয় অনূকূল সময়ে । এভাবেই তার সমাপ্তি হয়।

অচেনা অস্তিত্বের পিছে ছুটতে থাকা আমার নাকি হিতাহিত ভারসাম্য লোপ পেয়েছে। অথচ আমি জানি কোন এক মহাশূন্যের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছি। নিরন্তর এ আত্মনিমগ্নতাকে কেউ কেউ হ্যালুসেনিয়েশন নামকরণ দিয়ে আমাকে ঠাট্টা করতে উদ্ধত হলো। আমি জানি আমি তা নই। আমি নিয়ন্ত্রণ বলয়ের মাঝে থেকেই আমাকে সীমাহীন দূরে নিয়ে যেতে চেয়েছি।
এ জনাকীর্ণ লোকালয়ের পথে কেবলই আমি, আমি অদূর দূরের মাঝে কতক সু্ন্দরের সন্ধানে শেষমেশ আমাকে চিরবিলীন করেছি। আমার এ অবয়বকে তবু তারা বিভ্রম বলে উড়িয়ে দিল!

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *