স্বপ্ন শূন্যতার করতলে
স্বপ্ন শূন্যতার করতলে
“বিলম্বিত জবানবন্দি” অনুগল্পের কাব্যনাট্যরূপ
পারভেজ শিশির
দৃশ্য সংখ্যা: ১১
চরিত্র:
জয়া – একজন গভীরভাবে হ’তা’শ নারী, যিনি জীবনের প্র’তা’রণা ও ব্যর্থতার শিকার হয়ে আ’ত্ম’হ’ত্যা’র পথে যাচ্ছেন।
প্রহর – জয়া’র মনের প্রতিচ্ছবি, তার ভেতরের অস্পষ্ট অন্ধকার চিন্তা, যাকে মাঝে মাঝে সে বন্ধু হিসেবে দেখে, কখনো নিজের প্রতিপক্ষ হিসেবে।
দৃশ্য ১: [মঞ্চের বিবরণ]
মঞ্চের অর্ধেক অন্ধকার, মঞ্চের এক পাশে একটিমাত্র পাথরের বেঞ্চ। চারপাশে ধূসর আলো। মাঝে মাঝে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যাচ্ছে। মঞ্চের পেছনে বড় একটি পর্দায় জ্বলন্ত মোমবাতির ছায়া যেন ক্রমশ চঞ্চল হয়ে উঠছে।
জয়া (স্বগত):
(মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, চোখেমুখে ক্লান্তি)
আমার পায়ের নিচে মাটি নেই।
বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছা নেই।
কেউ বুঝলো না, কেউ জানলো না,
কেন আমার বুকের ভেতর শুধু
শূন্যতার সাইরেন বেজে যাচ্ছে।
প্রহর (অন্ধকার থেকে বেরিয়ে):
তুমি কি সত্যিই জানো, কেন?
(জয়া’র চারপাশে সে ধীরে ধীরে ঘুরছে)
কেন ক’রলে এমন? কীভাবে পারলে?
আমি তোমাকে কেবল বন্ধুত্বের অধিকার দিয়েছিলাম, জয়া…
জয়া (মাথা নিচু):
(শ্বেত পাথরের ভাস্কর্যের মতো সে যেন অনন্তকাল নিশ্চুপ রয়েছে…)
দৃশ্য ২: [মঞ্চের বিবরণ]
মঞ্চে আলোর পরিবর্তন। পেছনে হালকা বৃষ্টি ঝরে পড়ার মতো শব্দ। এক পাশে একটি জানালা। জানালার বাইরে থেকে দেখা যায় ঝড়ের আভাস।
জয়া (জানালার পাশে):
আমি জানতাম না, এভাবে মৃ’ত্যু এতটা শূন্যতা নিয়ে আসবে,
জীবনেও যে এমন নিঃসঙ্গতা ছিল…!
(দীর্ঘশ্বাস ফেলে)
আমি খুঁজছিলাম কোনো একটা আলো, কোনো আশ্রয়…
প্রহর (তাচ্ছিল্যের মৃদু হাসি):
আশ্রয়? তোমার আশ্রয় ছিল তোমার স্বপ্ন,
কিন্তু তুমি তাকে পেয়েছ কি?
(ঘনিয়ে আসে জয়া’র পাশে)
তুমি তো নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছ, জয়া…!
এখানে আর কোনো আলো নেই,
তোমার ভাষায় তা শুধু খয়েরি বাতাস।
কারণ তুমি এখনও চোখ বুজে আছো…
দৃশ্য ৩: [মঞ্চের বিবরণ]
একটি সাজানো ঘর, যেখানে একটি বইয়ের তাক ও টেবিলের পাশে একটি চেয়ার। জয়া টেবিলের প্রান্ত স্পর্শ ক’রে দাঁড়িয়ে রয়েছে, হাতের মুঠোয় একটি চিঠি।
(চিঠির দিকে তাকিয়ে):
এই চিঠি, যার কোনো প্রাপকের নাম নেই।
আমার সমস্ত কষ্ট, সমস্ত ব্যথা এখানে।
কিন্তু কেউ কি কখনো জানতে পারবে,
কেন আমি আ’ত্ম’হ’ত্যা করলাম?
(চিঠিটি ছুঁড়ে ফেলে)
প্রহর (পেছন থেকে):
তুমি কি আসলেই জানো, কেন?
কেন এমনভাবে হেরে গিয়ে আমাকেও হারিয়ে দিলে চিরদিনের জন্যে…!
আমার কবিতায় কি তুমি প্রগতির শব্দ খুঁজে পাওনি…!
(চিঠিটি তুলে নেয়)
তুমি অর্বাচীন প্রার্থনায় ডুবে ছিলে,
যে চিঠি কারো উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়নি
তার উত্তর তোমাকে কে দেবে…!
দৃশ্য ৪: [মঞ্চের বিবরণ]
মঞ্চে একটি সেতুর দৃশ্য। জয়া সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে। নিচে নদীর প্রবল ধারা।
জয়া (নদীর দিকে তাকিয়ে):
এই স্রোত আমাকে নিয়ে যাবে কোথায়?
আমি কি ভেসে যেতে পারি?
স্রোতের কাছে কি আমি নির্ভার?
কেউ কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য,
এই শূন্যতার বাইরে?
প্রহর (নির্দয় কণ্ঠে):
কেউ না, জয়া।
তোমার যাত্রা শুরু হয়েছে,
এ যাত্রা তোমার একার।
তুমি নিজেই নিজের শূন্যতায় হারিয়ে যাবে বলে যেন পণ করেছো…!
দৃশ্য ৫: [মঞ্চের বিবরণ]
অন্ধকার মঞ্চ। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন শোনা যায়। জয়া একা দাঁড়িয়ে, চারপাশে যেন হাহাকার করে ভাসছে একটি নারী কণ্ঠস্বর।
জয়া (আবছায়া অন্ধকারে):
আমি কিভাবে এখানে এলাম?
এখানে কিছুই নেই, শুধু একটানা নীরবতা কেন…!
(নিজের চারপাশে হাত বোলায়)
আমার চেনা দিন রাতের জগতে
আমি তো তোমার মতই বেঁচে ছিলাম
আমি তো ছিলাম, ছিলাম না?
প্রহর (দূর থেকে ফিসফিস করে):
তুমি ছিলে,
কিন্তু নিজের মাঝে তুমি কখনো ছিলে না।
তুমি নিজেই তো তোমার থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছো।
আমি যার ভক্ত, তুমি তার ভক্ত হতে চেয়েছ অথচ আমি যাকে ভালোবেসেছি
তুমি তাকে ঘৃণা করেছো…! কেন?
জয়া (স্মিত হাস্যমুখে)
কলেজের পর প্রথম যেদিন
তোমার সাথে দেখা হলো,
তা তোমার কবিতা আমি আগে পড়েছি,
কিন্তু সেদিন যেন বিবশ চোখে দেখলাম
ট্রাম থেকে নেমে এসে
সয়ং জীবনানন্দ আমার হাত ধ’রে বললেন,
“এতদিন কোথায় ছিলেন…!”
দৃশ্য ৬: [মঞ্চের বিবরণ]
মঞ্চের মাঝখানে একটি বড় আয়না। জয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। প্রহরের প্রতিচ্ছবি আয়নায় প্রতিফলিত হয়।
জয়া (আয়নার দিকে তাকিয়ে):
এতদিন আমি খুঁজছিলাম নিজেকে,
কিন্তু কেবলই খয়েরি বাতাস পেলাম।
এই আমি, আয়নার এই আমি কে?
পাশের এই তুমিটাই বা কে?
প্রহর (আয়নার ভেতর থেকে):
তুমি তো জানো না, কে তুমি।
তোমার সব কিছু ভেঙে গেছে,
তোমার ভুল, তোমার স্বপ্ন… সব…
আর এখন তুমি ভাঙা আয়নাতেই শুধু থাকতে পারো না,
বেরিয়ে এসো, এভাবে সর্বক্ষয়ী দুঃখ ক’রো না…
তোমার স্বাধীনতা এখনও হারিয়ে যায়নি..
দৃশ্য ৭: [মঞ্চের বিবরণ]
মঞ্চের পেছনে দূরের মাঠ, যেখানে রাত্রির আকাশে একচিলতে চাঁদ ঝলসে উঠেছে। জয়া হাত বাড়িয়ে সেই রুপালি আলো ধরতে চায়।
জয়া (আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে):
আমি কি আর একটিবার জ্যোৎস্না পাবো?
যে জ্যোৎস্নায় আমার সমস্ত দুঃখ গলে যাবে?
প্রহর (নিবিড় কণ্ঠে):
জ্যোৎস্না আর আসবে না, জয়া,
যদি তুমি চোখ না খোলো…
তুমি যা চেয়েছিলে, তা ছিল মরীচিকা।
তোমার সমস্ত ভাবনা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।
দৃশ্য ৮: [মঞ্চের বিবরণ]
মঞ্চের সামনে একটি টেবিলে ফুলের তোড়া রাখা। জয়া টেবিলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে।
জয়া (ফুলের দিকে তাকিয়ে):
এই ফুলগুলো, এরা জানে না কি ব্যথা আমি বয়ে বেড়াচ্ছি?
প্রত্যাখ্যান যে কী বিষ…!
কীভাবে আমার সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। সব কিছু জ্বলে যাচ্ছে…!
প্রহর (ফুলের ছায়ার মতো পাশে):
ফুল কখনো কিছু জানতে চায় না।
তারা শুধু ফুটে থাকে, আর মরে যায়।
এত ভেবে কি লাভ, তাই বা কী ক’রে বলি…
না ভেবেই যে পথে তুমি পা বাড়িয়েছো,
তার দায় আমার নয়, জয়া…
প্রতিজ্ঞা করো, তুমি ভালো থাকবে,
আমার এবার আসতে হবে…
দৃশ্য ৯: [মঞ্চের বিবরণ]
মঞ্চের পেছনের দেয়ালে একটি পুরোনো ঘড়ি টিকটিক করছে। জয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে। পেছন থেকে প্রহর’কে ডাকে…
জয়া (সময়কে লক্ষ্য করে):
এই সময় কতো দ্রুত বয়ে যাচ্ছে…!
আমি কিভাবে সব হারিয়ে ফেললাম?
আমি তো কারো কিছু কেড়ে নিইনি…!
প্রহর (দূর থেকে):
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, জয়া।
তুমি তাকে দোষ দিতে পারো না।
তোমার হাতে আর বয়ে যাওয়ার সময় নেই।
তোমার সময় তোমার থেকে অনেক অনেক দূর এগিয়ে গেছে,
তোমাকেও পা মেলাতে হবে…
দৃশ্য ১০: [মঞ্চের বিবরণ]
একটি পুরনো কুয়ো, যার ভেতরে জয়া ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রহর কুয়োর পাশে বসে।
অশনি (কুয়োর ভেতরে তাকিয়ে):
আমি কি এর ভেতরে ডুবে যেতে পারি?
শান্তি কি এখানেই আছে? ঘুম?
প্রহর (শীতলভাবে):
শান্তি? ঘুম? কি বলছো এসব..!
কুয়োর গভীরে কিছু নেই, শুধু শূন্যতা।
তুমি তো জানো, জয়া।
অথচ তুমি দেখতে পাচ্ছো না
তুমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছো…!
দৃশ্য ১১: [মঞ্চের বিবরণ]
মঞ্চের মাঝখানে একটি দোলনা। জয়া দোলনায় বসে, প্রহর তার পাশে দাঁড়িয়ে।
জয়া (নিঃশ্বাস ফেলে):
আমি তো অনেক কিছু চেয়েছিলাম,
কিন্তু কিছুই পেলাম না।
তাহলে এসব স্বপ্নের মানে কি?
আমার সব চাওয়াই কি ভুল…!
প্রহর (মৃদু হেসে):
স্বপ্নের কোনো মানে নেই,
মানুষ যা ভাবে, তাই নিয়ে সে স্বপ্ন দেখতে চায়
সে আসলে দেখেনা, দেখতে চায়…
তুমিও তাই চেয়েছিলে, কিন্তু পেতে পারোনি।
তবে স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলে
জীবন কখনও থেমে যায় না…
জয়া (শেষবারের মতো):
হ্যাঁ, থেমে যায়। কারো কারো যায়,
তোমার কবিতা পড়ে একদিন খুব হেসেছিলাম— (মুখে মৃদু হাসি)
নাও তুমি জিতে গিয়েছো,
জীবনের ধাতব রাস্তায় হোচট খেতে খেতে কবে পঙ্গু হয়ে গিয়েছি
সত্যিই বুঝতে পারিনি…!
(মঞ্চে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসে। শোনা যায় শূন্য বাতাসের শব্দ। কারো পায়ে নিচে… অথৈ…)