ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

সে যে চলে গেলো, ফিরে এলো না

0

সে যে চলে গেলো, ফিরে এলো না

চন্দ্রাবলী মুখোপাধ্যায়

এই সকাল ন’টা টেক হবে আর কি। রাসবিহারী অ্যাভিনিউ । মহানির্বান মঠের সামনে বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে । একটু যে বসবো তার উপায় নেই। এদিক-ওদিক দেখছি, ঠিক তখনই পাশের চা-দোকানের ঝাঁপ খুললো । মেয়েটার গাছকোমড় বাঁধা শাড়ীতে মাথায় টাইট খোঁপা । দেহাতি । এটা ওটা গোছাতে গোছাতে জিজ্ঞেস করলো

–মঠে এয়েছেন বুঝি? নেমন্তন্ন?

হকচকিয়ে বললাম না মানে ইয়ে… মানে বাবা…

কথা শেষ হলো না।

—ও বুয়েচি। ছেরাদ্দ হবে?

–হুঁ

টানতে টানতে কাঠের বেঞ্চটা আমার সামনে নিয়ে এলো

–এইখেনে বয়েন। আপিচ খুলতে মেলা দেরী। দাঁইরে দাঁইরে পা ভেরিয়ে যাবে ।

আমিও ভ্যাবলার মতো বসে পড়লাম ।

–এই ন্যান চা । আপনের হাতে বৌনি হলো বটে ।

–কিন্তু আমার যে অশৌচ চলছে । এ হাতে বৌনি করলে যে …

— বাপ মরেচে বলি কি চা খাপি না । মা গো মা—ই কি রকম কতা? এখেনে যবে থেকে দোকান দিচি সবাই….

বাকীটা আর কানে নেওয়ার আগেই অফিস খুলেছে । দুদ্দাড় গতিতে এক ছুট । কোন তারিখ পড়বে? বুকিং পাবো কিনা । দপদপ করছে মাথা । অবশেষে অফিসের দরজার চৌকাঠ । এখানে সবাই কেমন যান্ত্রিক । দোষ দেওয়া যায় না । নিত্যনৈমিত্তিক একই কাজ ঠেলতে ঠেলতে আবেগ কোণঠাসা হয়ে গ্যাছে । যাবতীয় নিয়ম-কানুন মেনে ফর্মে সই-সাবুদ ক’রে বেরিয়ে এলাম।

চা-দোকান ততক্ষনে জ’মে গেছে । আর দাঁড়ালাম না । ফুটপাথ ধ’রে গড়িয়াহাট মোড়ের দিকে হাঁটছি। অন্যমনস্ক, ফাঁকা ফাঁকা, চিমনির পাকে কালো ধোঁয়া, সেই ছাই-এর ট্রে । উফফ্…

মমতা-স্নেহ যা কিছু ছিল, মৃত্যুর গর্ভে আজ তা বিলীন। সংগ্রামের এই তো শুরু । বারবার তর্জনী তুলে শাসন করে চলেছে । থেকে থেকে ক্লান্ত শরীর শিউরে উঠছে। একটা আশঙ্কা হৃদপিণ্ডকে চেপে ধরে আছে। পারবো তো সব ? শ্রাদ্ধশান্তির কাজে কোনো ত্রুটি থাকবে না তো ? মা-কে যে কথা দিয়েছি ।

এই মাত্র ক’দিন হলো বাবা নেই । তবু সংসার যথাযথ, নিয়মমাফিক।

পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয় নি । আকাশে কোনো চিন্তার রেখা নাই। জ্যোৎস্নায় চাঞ্চল্য নেই। রাত্রি নিস্তব্ধ, শান্ত । বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড কে অন্তরে ডাক দিই । সবাই মুচকিয়ে হাসে । গ্রাহ্য করে না । বুঝি সব কিছুর মতো এ যাতায়াত অনিবার্য।

আমার ভেতরে এক অপরিমেয় শূণ্যতা । একান্তে তাকে কারুকার্য করে অনেক রূপদান করার চেষ্টা করছি । পারছি না । কিছুতেই পারছি না । আর নয় এবার বিধাতার কাছ থেকে নিষ্কৃতি চেয়ে বসলাম।

মুহূর্তে মোবাইলে মা

— কি রে কাজ মিটলো? হবিষ্যির সময় হয়ে আসছে । যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি …

এক বিশাল সত্যির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তখন। মায়ের সবটুকু সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ আমার বুকের কাছে এসে ঠেকেছে। ভাঙা টুকরো নয়, আস্ত এক জগত, জীবনের উত্তাপে এখন-ও তিনি আমায় লালন করে চলেছেন ।

এখনই নিষ্কৃতি? স্বার্থপরের মতো এযে আমার অবান্তর চাহিদা।

ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *