সাহিত্য বানিজ্যের নামে বিভাজন: সাহিত্যিক সম্মান ও বৈষম্যের সংকট

সাহিত্য বানিজ্যের নামে বিভাজন: সাহিত্যিক সম্মান ও বৈষম্যের সংকট
পারভেজ শিশির
সাহিত্যের ক্ষেত্রে লেখক সমাবেশ ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠান আয়োজকদের উদ্দেশ্যে দুটি কথা—
বর্তমান সাহিত্য সমাজে একটি গভীর সংকট বিরাজমান। সাহিত্যিক সম্মান, সমাবেশ, ও সাহিত্য সংগঠনের নামে যে বৈষম্য ও বানিজ্যিকীকরণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা প্রকৃত সাহিত্যিকদের প্রতি একটি সুস্পষ্ট অবমাননার উদাহরণ। বিশেষ করে অনলাইন সাহিত্য সংগঠনগুলোর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন ও লেখক সমাবেশে রেজিস্ট্রেশন ফি, ডোনেশ্যন, এবং সম্মাননার নামে যে ধূর্ত ব্যবসা চলছে, তা সাহিত্যিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সাহিত্যের নামে বানিজ্য: এক লজ্জাজনক রূপান্তর—
একটি সময় ছিল যখন সাহিত্যিক সমাবেশ মানে ছিল সৃষ্টিশীল চর্চার বিনিময়, অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি এবং নতুন প্রতিভার উন্মেষের সুযোগ। কিন্তু বর্তমান সময়ে এটি হয়ে উঠেছে একটি পুঁজিবাদী মঞ্চ।
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন, লেখক সম্মেলন, কিংবা সাহিত্য প্রতিযোগিতা—সবকিছুর মধ্যেই এখন একটি বানিজ্যিক উদ্দেশ্য স্পষ্ট। বিশাল অঙ্কের রেজিস্ট্রেশন ফি এবং ডোনেশ্যনের মাধ্যমে সংগঠনগুলো নিজেদের আয় বাড়াতে ব্যস্ত। এদের অধিকাংশই সাহিত্যিক মানের পরিবর্তে আর্থিক অবদানের ভিত্তিতে লেখকদের সম্মাননা প্রদান করে। প্রকৃত কবি কিংবা লেখকের চেয়ে তথাকথিত ‘এলিট শ্রেণির কলমধারী’রাই আজ এসব আসরে প্রাধান্য পাচ্ছেন।
এলিট শ্রেণির দৌরাত্ম্য—
প্রকৃত সাহিত্যিকের প্রতি অবমাননা
অনলাইন সাহিত্য প্ল্যাটফর্ম ও সংগঠনগুলোতে একটি বিশেষ শ্রেণির দাপট স্পষ্ট। এ শ্রেণির সদস্যরা মূলত তাদের আর্থিক সামর্থ্য এবং সামাজিক প্রভাবের কারণে প্রতিষ্ঠিত। তারা নিজেদের লেখালেখির মান কিংবা সৃষ্টিশীলতার চেয়ে বানিজ্যিক যোগসাজশের মাধ্যমে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করে, সমাজে নিজেদের ব্র্যান্ডিং করে চলেছেন।
প্রকৃত সাহিত্যিক, যারা গভীর জীবনবোধ, অভিজ্ঞতা এবং সাহিত্যিক সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন, তারা এই প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি বঞ্চিত। এসব এলিট শ্রেণি কেবল নিজেদের মতো করে একচেটিয়া একটি মঞ্চ তৈরি করেছে, যেখানে প্রকৃত প্রতিভার কোনো স্থান নেই।
সম্মাননার নামে বৈষম্য—
সম্মাননা প্রদানের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে একটি অশুভ প্রবণতা। আজকাল যে কেউ সম্মাননার জন্য নির্বাচিত হতে পারে, যদি তার আর্থিক অবদান পর্যাপ্ত হয়। অনলাইনে তথাকথিত লেখক বা কবিদের নাম ঘোষণা করা হয় সম্মাননার জন্য,
কিন্তু প্রকৃত মূল্যায়ন বা সাহিত্যিক যোগ্যতার কোনো পরিসর সেখানে নেই। সুবিধা ও সুনামকৌশলী বহিরাগতরা (যারা সাহিত্যের বাইরের মানুষ) আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে মঞ্চে একবার কবিতা পড়তে ওঠেন, ১ মিনিটের শুভেচ্ছা বক্তব্য ৫ মিনিট দীর্ঘায়িত করেন, ও মঞ্চ অতিথির নাম পরিচয় প্রদান করে কালক্ষেপণ করেন, তাদের বক্তব্য হয় ধীর উচ্চারণে অহমিকাপূর্ণ স্বরে, ফলে তালিকাভুক্ত স্বরচিত কবিতা আবৃত্তিকার আর মঞ্চের ডায়াসের ধারে কাছেই ভিড়তে পারেন না অথবা সেই ইচ্ছে ত্যাগ করেন। আসল সাহিত্যের মানুষেরা, ইঁদুর দৌড়ের এই প্রতিযোগিতায় নিজেদেরকে মেনে নিতে না পেরে, একেবারে দর্শক সারির পেছনে চলে যান।
যারা সত্যিকারের সাহিত্যচর্চা করেন, তারা এ মঞ্চ কেন, এসব অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকেন, হয়তো অপমানিত বোধ করেন।
প্রকৃত সাহিত্যিকদের লড়াই—
এই পরিস্থিতিতে প্রকৃত সাহিত্যিকরা একপ্রকার একঘরে হয়ে পড়ছেন। তারা সাহিত্যকে জীবনবোধ এবং মননশীলতার মাধ্যম হিসেবে দেখেন, যা অর্থনৈতিক লাভ বা সামাজিক প্রতিপত্তির জন্য নয়। তাদের জন্য এধরনের বৈষম্যমূলক সাহিত্য মঞ্চ একটি বড় আঘাত।
প্রতিকার ও করণীয়
১. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা:
অনলাইন সাহিত্য সংগঠনগুলোকে তাদের কার্যক্রম ও অর্থব্যবহারে স্বচ্ছতা আনা জরুরি। রেজিস্ট্রেশন ফি বা ডোনেশ্যনের অর্থ কোথায় ব্যয় হচ্ছে, তার বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা উচিত।
২. প্রকৃত সাহিত্যিকদের মূল্যায়ন:
সম্মাননা প্রদানের ক্ষেত্রে আর্থিক অবদান নয়, লেখকের সাহিত্যকর্মের মান, প্রভাব, এবং সৃষ্টিশীলতাকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন।
৩. গণমাধ্যম ও জনসচেতনতা:
এই বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা ও সমালোচনা বাড়ানো দরকার, যাতে সাধারণ সাহিত্যপ্রেমীরা এধরনের বানিজ্যিক সাহিত্য কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন হন।
যা বলতেই হবে —
সাহিত্য একটি মননশীল চর্চা; এটি কোনো পণ্য নয়। সাহিত্যিক মূল্যবোধকে রক্ষা করতে হলে এসব বানিজ্যিক প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। এলিট শ্রেণির কলমধারী নয়, প্রকৃত সাহিত্যিকদের মঞ্চে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সাহিত্য একসময় প্রতিবাদের ভাষা ছিল, বঞ্চিতদের কণ্ঠস্বর ছিল। আজকের এই বিভক্ত ও বানিজ্যিক সাহিত্যের যুগে, প্রকৃত সাহিত্যিকদের দায়িত্ব বহুগুণ বেড়ে গেছে। তাদের সৃষ্টিশীল লড়াই-ই পারে এই অন্ধকার যুগ থেকে সাহিত্যকে মুক্তি দিতে।