অক্টোবর ২৭, ২০২৪

মধ্যরা‌তের অশরী‌রী আততায়ী

1

মধ্যরা‌তের অশরী‌রী আততায়ী

শাহীনুর আসিফ

ছিঃ স‌খিনা। স্বপ্ন দেখ‌লে বু‌ঝি কাঁদ‌তে হয়?
খুব‌ খারাপ খোয়াব। আপনা‌রে নিয়া ডর লাগতা‌ছে ভীষণ। এম‌নে আপ‌নে পু‌লি‌শে চাক‌রি ক‌রেন।
‌তো কী হ‌য়ে‌ছে! পু‌লি‌শে তো কত হাজার মানুষ চাক‌রি কর‌তে‌ছে। কর‌তে‌ছে না?
হুম।
তাহ‌লে? আচ্ছা বল দে‌খি তোমার খোয়া‌বের ঘটনা? বুঝ‌ছি, আমা‌রে না বলা পর্যন্ত তোমার ভয় কাট‌বো না।
কন কী! এই রাই‌তের বেলা কওয়া যাই‌বো না। আপনার ক্ষ‌তি হইতে পা‌রে।
আ‌রে কত যে কুসংস্কার তোমার ম‌ধ্যে।
সকা‌লে কমু নে।
আচ্ছা। স‌খিনা এহন তাই‌লে রা‌খি। ডিউ‌টি‌তে আছি তো। আমার আবার টা‌ট্টিখানায় যাওয়া লাগ‌বে।
আচ্ছা। তয় সাবধা‌নে থাক‌বেন। দিনকাল ভালা না।
আচ্ছা। বাচ্চা‌দের দি‌কে খেয়াল রাই‌খে‌া।
‌ফোন রে‌খে আবুল হো‌সে‌নের মন খারাপ হয় বউ‌য়ের জন্য। বউটা বেচারা একা একা‌ রা‌তি পার কর‌ছে। এজন্যেই হয়‌তো ভয়ংকর স্বপ্ন দেখ‌ছে। সেই সা‌থে সে কিছুটা অবাক‌ হয়। সবু‌রের মত সেও টা‌ট্টিখানা ব‌লে ফে‌লে‌ছে! একেই ব‌লে বোধহয় সঙ্গ‌দোষ। ফো‌নে কথায় কথায় সে মস‌জি‌দের সাম‌নে চ‌লে এসে‌ছে। খেয়ালই ক‌রে‌নি। এখন আবার সে প্রবল চাপ অনুভব কর‌ছে। টয়‌লে‌টে যাওয়াটা জরুরী। আবুল খেয়াল ক‌রে মস‌জিদ পু‌রোটা বন্ধ। ত‌বে মস‌জিদ লা‌গোয়া আলাদা টয়‌লেট। আকা‌শে চাঁদ নেই। ত‌বে অসংখ্য নক্ষ‌ত্রের আলোয় সব‌কিছু মোটামু‌টি স্পষ্ট দেখ‌া যা‌চ্ছে। পাশাপা‌শি দুইটা টয়‌লেট। আবুল হো‌সেন সাম‌নে এগি‌য়ে গি‌য়ে হা‌তের টর্চ লাইটটা জ্বালায়। তারপর প্রথমটায় উঁকি দি‌তে দে‌খে লো কো‌মোড। সে দ্বিতীয়টার দরজা বাই‌রে থে‌কে টান দি‌তেই দে‌খে সেটা লক করা। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর টয়‌লে‌টের ভেতর থে‌কে পা‌নি পড়ার শব্দ শুন‌তে পায় আবুল। তার অল্প সময় প‌রে টয়‌লে‌টের দরজাটা ভেতর থে‌কে খু‌লে যায়। সে অপেক্ষায় থা‌কে ভেত‌রের লোক হয়‌তো বের হ‌বে। কিন্তু ভেতর থেকে আর কেউ বের হয় না। আবুল হা‌তের টর্চটা ভিত‌রে মে‌রে দে‌খে সেখানে কেউ নেই! অতি‌রিক্ত চা‌পের কার‌ণে সে বে‌শি কিছু চিন্তা না ক‌রে ঢু‌কে প‌ড়ে। দরজাটা বন্ধ করার সা‌থে সা‌থে আবুল গরম একটা বাতাস অনুভব ক‌রে। ম‌নে হয় তার সা‌থে কে যেন ঢু‌কে‌ছে। আবুল নি‌জের মন‌কে প্র‌বোধ দেয় সব ম‌নের ভুল। দূ‌রে কোথাও যেন একসা‌থে অনেকগু‌লো শিয়াল‌ ডে‌কে ও‌ঠে। ম‌নে হয় যেন ওগু‌লে‌া আর্তনাদ কর‌ছে। টয়‌লে‌টের পেছ‌নে একটা বিশাল গাছ। সেই গা‌ছের ডা‌লে একটা পেঁচা করুণ সু‌রে ডে‌কে ও‌ঠে। আবুল হো‌সে‌নের মনট‌া হঠাৎ কেমন ক‌রে ও‌ঠে। বউ, ছে‌লে-‌মে‌য়ের কথা ম‌নে প‌ড়ে তার। ঠিক সেই সময় তার হা‌তে থাকা টর্চলাইটটা নি‌ভে যায়। সা‌থে সা‌থে সে ট‌র্চের সুইচটা অন-অফ ক‌রে। দু’‌তিনটা ঝাঁ‌কি দেয়। কিন্তু তারপরও টর্চ থে‌কে আর আলো বের হয় না। আবারও সে দূরাগত শিয়া‌লের করুণ আর্তনাদ শুন‌তে পায়। যেন তার আসন্ন বিপ‌দে ওরা কাঁদ‌ছে। ঠিক তখনই ম‌নে হয় কে যেন তার মাথাটা চে‌পে ধ‌রে‌ছে। আবুল হো‌সেন প্রাণপ‌নে ছোটা‌নোর চেষ্টা ক‌রে। কিন্তু সে ব্যর্থ হয়। মুখ দি‌য়ে একটা চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা ক‌রে। কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হয় না! অস্ফুট স্ব‌রে শুধু বল‌তে পা‌রে- কে? জবা‌বে একটা ঘড়-ঘ‌ড়ে আওয়াজ শুন‌তে পায় সে। তারপর তার মাথাটা আস্তে নি‌চের দি‌কে নাম‌তে থা‌কে। ম‌নে হয় বিশাল শ‌ক্তির কিছু যেন তার মাথাটা টে‌নে ধ‌রে নি‌চের দি‌কে নামাচ্ছে। তার মুখটা এখন ক‌মো‌ডের কাছাকা‌ছি। বহু ক‌ষ্টে আবুল তার মুখটা একবার পেছন দি‌কে ঘোরা‌তে পা‌রে। দে‌খে বেশ লম্বা পু‌রোপু‌রি লাল রং‌য়ের একটা অবয়ব। ম‌নে হয় যেন আগু‌নের একটা অগ্নিকুন্ড! শুধু চোখগু‌লে‌া সবুজ রং‌য়ের। গাঢ় অন্ধকা‌রেও জ্বলজ্বল কর‌ছে। সে ফি‌রে তাকা‌নোয় দানবটা যেন ক্ষে‌পে যায়। একটা ঘড় ঘড় আওয়াজ ক‌রে মুখ দি‌য়ে। সা‌থে সা‌থে আবুল হো‌সেন তার দু’‌চো‌খে ধারা‌লো কিছুর আঘাত অনুভব ক‌রে। ম‌নে হ‌চ্ছে কে যেন ছু‌রির মত ধারা‌লো কিছু দি‌য়ে তার চোখগু‌লো উপ‌ড়ে ফেল‌ছে! যন্ত্রণায় কুঁক‌ড়ে ও‌ঠে সে। কিন্তু তারপরও আবুল হো‌সে‌নের মুখ দি‌য়ে কোন আওয়াজ বের হ‌চ্ছে না! অনেক চেষ্টা ক‌রেও সে কোন আওয়াজ কর‌তে পার‌ছে না! তারপর দানবটা স‌বে‌গে আবু‌লের মুখটা চে‌পে ধ‌রে ক‌মো‌ডের ভেতর। সর্বশ‌ক্তি প্র‌য়োগ ক‌রেও আবুল নি‌জে‌কে আর রক্ষা কর‌তে পা‌রে না। ‌মৃত্যুযন্ত্রণার সা‌থে সা‌থে তার দু’সন্তা‌নের কথা ম‌নে প‌ড়ছে। মে‌য়েটা তার জন্য মাথার ফিতা আর পুতুল কি‌নে নি‌য়ে যে‌তে ব‌লে‌ছিল। অভিমানী বউটার কথাও ম‌নে প‌ড়‌ছে। যে তা‌কে ছাড়া নিঃসঙ্গ রাত কাটায় ব‌লে প্রায়ই অভিমান ক‌রে। আবু‌লের এখন নিঃশ্বাস নি‌তে কষ্ট হ‌চ্ছে। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য মুখ খুল‌তেই ক‌মো‌ডের নোংরা পা‌নি কিছুটা তার মুখের ভেতর ঢুকে প‌ড়ে। অক্সি‌জে‌নের অভা‌বে আবু‌লের পু‌রো শরীর অসাড় হ‌য়ে গি‌য়ে‌ছে। তারপরই যেন সে অন্ধকা‌রের এক অতল জগ‌তে প্রবেশ ক‌রে। তার পু‌রো শরীরটা একবার ঝাঁ‌কি দি‌য়ে নি‌স্তেজ হ‌য়ে যায়।
সবুর আর সাজ্জাদ অনেকক্ষণ ধ‌রে ব‌সে আছে টিস্ট‌লের বে‌ঞ্চি‌তে। কিন্তু তা‌দের সহকর্মী আবুল হো‌সে‌ন এখনও ফি‌রে আসে‌নি। সবুর হা‌ত ঘ‌ড়ি‌তে সময় দে‌খে। রাত একটা বা‌জে। ঠিক একঘন্টা হ‌য়ে‌ছে। অথচ তা‌দের সি‌নিয়র সহকর্মী আবুল এখনও ফি‌রে আসে‌নি। টয়‌লে‌টে গি‌য়ে কি আবুল ঘু‌মিয়ে গেল না‌কি? সবুর যখন এগু‌লো চিন্তা কর‌ছে ঠিক সে মুহূ‌র্তে ও কা‌কে যেন দূর থে‌কে হেঁটে আসতে দেখে। অবয়বটা একটু কাছে আস‌তেই সবুর আর সাজ্জাদ বুঝ‌তে পা‌রে আবু্ল হো‌সেন আস‌ছে। একটু নিকট আস‌তেই আবু‌লের চেহারার ম‌ধ্যে তারা বিষন্ন ভাব লক্ষ্য ক‌রে। আরো একটু কা‌ছে আস‌তেই সবুর আর সাজ্জাদ বুঝ‌তে পা‌রে সে স্বাভা‌বি‌কের চে‌য়ে বেশ দ্রুত হেঁ‌টে আস‌ছে। তা‌দের কাছাকা‌ছি এসে না থে‌মে শুধু এক পলক তাকায় সবু‌রের দি‌কে। তারপর ব‌লে- সবুর তু‌মি এসো আমার স‌ঙ্গে।
‌কোথায় যা‌বো স্যার?
সবুর প্রশ্ন ক‌রে ঠিকই। কিন্তু সে আর উত্তর পায় না। হনহ‌নি‌য়ে আবুল তা‌দের অতিক্রম করে চ‌লে যায়। যেন সে হাওয়ার বে‌গে ছুট‌ছে। বাধ্য হ‌য়ে সবুর তা‌কে অনুসরণ ক‌রে। আবু‌লের কণ্ঠটাও যেন কেমন ধাতবকণ্ঠ। যেন আবুল নয় রোবট কথা বল‌ছে। তার‌চে‌য়েও অদ্ভুত বিষয় তার পি‌ঠে ছোপ ছোপ র‌ক্তের দাগ। সবুর যেন এ মুহূ‌র্তে কথা বলার শ‌ক্তি হা‌রি‌য়েছে। মোহগ্রস্ত হ‌য়ে সে শুধু আবুল‌কে অনুসরণ ক‌রে চ‌লে‌ছে। আর দূ‌রে টিস্ট‌লের বে‌ঞ্চি‌তে ব‌সে অবাক বিস্ম‌য়ে চে‌য়ে র‌য়ে‌ছে সাজ্জাদ।

চলবে………

অক্টোবর ২৭, ২০২৪

About The Author

১ thought on “মধ্যরা‌তের অশরী‌রী আততায়ী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *