জানুয়ারি ৯, ২০২৫

মধ্যরা‌তের অশরীরী আততায়ী

0

মধ্যরা‌তের অশরীরী আততায়ী

শাহীনুর আসিফ

বিন্দুবা‌সিনী বা‌লিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালীন ছু‌টি চল‌ছে। য‌দিও এবার ছু‌টিটা হ‌য়ে‌ছে একটু আ‌গে। তার মূল কারণ ম্যাস হি‌স্টি‌রিয়ায় আক্রান্ত হ‌য়ে‌ছিল স্কু‌লের অ‌ধিকাংশ ছাত্রী। তাই বিভাগীয় শহর থে‌কে আসা মে‌ডি‌কেল টি‌মের পরাম‌র্শে বাধ্য হয়ে আ‌গেই বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা ক‌রা হ‌য়ে‌ছে।‌ এখন অবশ্য স্কু‌লের আ‌ধিকাংশ ছাত্রী সুস্থ আ‌ছে। আর অল্প ক’দি‌নের ম‌ধ্যেই স্কুল খু‌লে দেওয়া হ‌বে। ‌এ‌দি‌কে প্রধান শিক্ষক আবদুর রহমান সা‌হেব স্ব‌স্তি‌তে নেই! যতই স্কুল খু‌লে দেওয়ার সময় ঘ‌নি‌য়ে আস‌ছে ততই তাঁর আতংক বৃ‌দ্ধি পা‌চ্ছে। ক‌ারণ এখন পর্যন্ত তি‌নি স্বপ্নটা বেশ ক‌য়েকবার দে‌খে‌ছেন। তাঁর মন বল‌ছে খুব খারাপ কিছু ঘট‌তে চ‌লে‌ছে। খুব খারাপ! কিন্তু তি‌নি তাঁর এই স্ব‌প্নের কথা, আশংকার কথা কাউ‌কেই বল‌তে পার‌ছেন না। কারণ সবাই হয়‌তো তা‌কে পাগল ভাব‌বে। কেউ তাঁর স্ব‌প্নের কথা‌বিশ্বাস কর‌বে না। বরং কুসংস্কারাচ্ছন্ন ম‌রোভা‌বের কার‌ণে তাঁর চাক‌রীও চ‌লে যে‌তে পা‌রে। এ‌সব ব্যাপার নি‌য়ে
যখন তি‌নি চি‌ন্তিত ঠিক তখনই তাঁর সেল‌ফোনটা বে‌জে ও‌ঠে। রহমান সাহেবের মনটা ধক ক‌রে ও‌ঠে। তাঁর ম‌নে হ‌চ্ছে নিশ্চয় কোন ভয়ংকর খব‌র ত‌ার জন্য অ‌পেক্ষা ক‌র‌ছে। তি‌নি কাঁপা কাঁপা হা‌তে ফো‌নটা পাঞ্জা‌বির প‌কেট থে‌কে বের ক‌রেন। ‌ফো‌নের স্ক্রি‌নের দি‌কে তা‌কি‌য়ে দে‌খেন স্কু‌লের পিয়ন ফোন ক‌রে‌ছে। তি‌নি ফোন রি‌সিভ কর‌বেন না সিদ্ধান্ত নি‌য়েও নি‌জের অজা‌ন্তেই রি‌সিভ বাটনটা প্রেস ক‌রেন। ওপ্রান্ত থে‌কে পিয়ন আক্কা‌সের উ‌দ্বিগ্ন কণ্ঠ ভে‌সে আ‌সে-
আসসালামু ওয়ালাইকুম। স্যার আ‌মি আক্কাস।
হু বল আক্কাস।
স্যার আপনার কথা এমন শুনাই‌তে‌ছে কেন! আপ‌নি অসুন্থ না কি?
আহা আ‌মি সুস্থ আ‌ছি। বল তো এখন কী বল‌বে..
স্যার অষ্টম শ্রে‌ণির রু‌বিনার বাবা এ‌সে‌ছিল স্কু‌লে। কাউ‌রে না পাইয়া শে‌ষে আমার কা‌ছে ব‌লে গে‌ছে..।
এইটুক ব‌লে আক্কাস চুপ হ‌য়ে যায়। ওর এই এক সমস্যা। কথার মাঝখা‌নে চুপ হ‌য়ে যাওয়া। প্র‌য়োজনীয় কথা হ‌লে আরও বে‌শি ক‌রে এরকম।
আক্কাস থাম‌লে কেন? শেষ কর‌বে তো পু‌রো কথাটা।
জি স্যার যা কই‌তে‌ছিলাম। রু‌বিনার আব্বা আস‌ছিল আজ‌কে স্কু‌লে।
আহা আক্কাস কথা সং‌ক্ষেপ কর। কী ব‌লে‌ছে সেটা বল..।
জি স্যার সেটাই কইতা‌ছি। রু‌বিনার আব্বা কই‌ছে তার মাইয়ার অবস্থা আবার খারাপ কর‌ছে।
মা‌নে?
স্যার আ‌গের মত না কি আবার পাগলা‌মি করতা‌ছে। নি‌জে নি‌জে শুধু হা‌সে। দুইরকম ক‌ণ্ঠে কথা কয়!
আল্লাহ্ রহম করুন।
রহমান সা‌হেব বিড় বিড় ক‌রে ব‌লেন। তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস ভা‌রি হ‌য়ে আস‌ছে। টেনশন হ‌চ্ছে খুব। ত‌বে কি স্বপ্নটা তার স‌ত্যি হ‌তে চ‌লে‌ছে!
ঠিক আ‌ছে আক্কাস তোমার সা‌থে আ‌মি প‌রে কথা বলব। এখন রা‌খো।
ফোনটা রে‌খে রহমান সা‌হেব হাত ঘ‌ড়ি‌তে সময় দে‌খেন। রাত আটটার বে‌শি বা‌জে। তি‌নি এশার নামা‌জ পড়ার জন্য ঘর থে‌কে বের হন।
স‌খিনা বেগ‌মকে পাওয়া গি‌য়ে‌ছে গ্রা‌মের শেষপ্রা‌ন্তে খা‌লের পা‌ড়ে। ত‌বে জী‌বিত নয় মৃত। একদম ছিন্ন-‌ভিন্ন একটা দেহ। তার চোখগু‌লে‌া উপড়া‌নো‌ ছিল। আর বু‌কের মাঝখান থে‌কে আড়াআ‌ড়িভা‌বে ছিঁ‌ড়ে কেউ যেন হৃদ‌পিন্ডটা বের ক‌রে নি‌য়ে‌ছে! ম‌নে হয় যেন অ‌নেক আ‌ক্রো‌শে কেউ স‌খিনা‌কে হত্যা ক‌রে‌ছে। আর স‌খিনার লাশটা যখন খালপাড়ে পাওয়া যায়
তখন লাশটা অর্ধউলঙ্গ এবং উপুড় হ‌য়ে প‌ড়ে‌ছিল। তাই প্রথ‌মে গ্রা‌মের কেউ লাশটা যে স‌খিনার সেটা বুঝ‌তে পা‌রে‌নি। প‌রে পু‌লিশ এ‌সে সুরতহ‌াল রি‌পো‌র্টের সময় লাশটা চিত কর‌লে সবাই চিন‌তে পা‌রে।
পু‌লিশ কনস্টেবল সবুর সুস্থ হ‌য়ে বা‌ড়ি ফি‌রে‌ছে। ত‌বে সে এখনও কা‌জে যে‌াগদান ক‌রে‌নি। সে এখনও মানসিকভা‌বে পু‌রোপু‌রি সুস্থ হ‌তে পা‌রে‌নি। মা‌ঝে মা‌ঝেই সে অদ্ভুত, অস্বাভা‌বিক আচরণ কর‌ছে। তা‌কে দেখ‌তে আসা মানুষ‌দের দি‌কে সে কিছুক্ষণ এক দৃ‌ষ্টি‌তে চে‌য়ে থা‌কে। তারপর চোখ-মুখ শক্ত ক‌রে ব‌লে- পু‌রো শহরটা শ্মশানভূ‌মি ক‌রে দিব। কত বড় সাহস আমার কা‌জে বাধা দিস। তোরা কেউ বাঁচ‌তে পার‌বি না। অবশ্য এর কিছুক্ষণ পরেই সবুর আবার স্বাভা‌বিক হ‌য়ে যায়। বর্তমা‌নে একজন সাই‌কিয়া‌ট্রি‌স্টের অ‌ধী‌নে সবু‌রের চি‌কিৎসা চল‌ছে।
রু‌বিনা এখন আ‌গের চে‌য়ে ভাল আ‌ছে। আজ‌কে সকাল থে‌কে বেশ ভ‌াল আচরণ কর‌ছে সবার সা‌থে। ‌সে বেশ সকা‌লে আজ ঘুম থে‌কে ও‌ঠেছে। হাত-মুখ ধু‌য়ে প্রায় ঘন্টাখা‌নেক পড়া‌লেখা ক‌রে। তারপর রান্নাঘ‌রে গি‌য়ে তার মা‌’‌কে সকা‌লে‌র নাস্তা বানা‌নোর কাজে সাহায‌্যও ক‌রে। রওশন আরা তার মে‌য়ের এমন স্বাভা‌বিক আচর‌ণে বেশ অবাক হন। কারণ বেশ ক’‌দিন ধ‌রে মে‌য়ে তা‌দের অদ্ভুত আচরণ কর‌ছিল। কোন কারণ ছাড়াই কেমন যেন একটা পৈশা‌চিক হা‌সি হাস‌ছিল অনবরত। কখনও আবার দ্বৈতক‌ণ্ঠে কথা বলা। এমন কথা বলার ধরনটাও ভয়ংকর! প্রথ‌মে নারী ক‌ণ্ঠের কেউ একজন প্রশ্ন ক‌রে, তারপর পুরুষালী কেউ সে প্র‌শ্নের উত্তর দেয়। কিছু প্রশ্ন-উত্ত‌রের নমুনা নিন্মরূপ:
নারীকণ্ঠ- কী‌রে মে‌য়েটার ভেতর আর কয়‌দিন ব‌সে থাক‌বি? কিছু কর‌বি না?
পুরুষকণ্ঠ- আ‌রে সময় দে কয়টা দিন। ও‌রে নি‌বো তো অবশ্যই। ক‌য়েকটা দিন একটু রওশন আরার মজার মজার খাবার খাই।
তারপর হা‌সি। সেই হা‌সি বেশ বিদঘু‌টে।
হুম মুরু‌ব্বির হুকুম ছাড়াও তো কিছু করা যা‌বে না। পুরুষকণ্ঠটা ব‌লে।
চল কামাল মিয়া‌র সাথে একটু মজা ক‌রি। বেটা আবার মে‌য়ে‌লোক পছন্দ ক‌রে। এ কথা ব‌লেই নারীকণ্ঠ হা‌সি‌তে ফেঁ‌টে প‌ড়ে। তারপর পুরুষকণ্ঠও সে হা‌সি‌তে যোগ দেয়। হা‌সি শেষ হ‌লে উভয়ই হিস হিস ধর‌নের একটা আওয়াজ ক‌রে। তখন কোন একটা অদ্ভুত ধর‌নের ভাষায় তা‌দের আল‌াপ চল‌তে থা‌কে। বড়ই অদ্ভুত সে ভাষা। যেটা এই ধ‌রিত্রীর চেনা-জানা ভাষার সা‌থে কোন মিল নেই! ইহজগ‌তের বাই‌রের কিছু যেন এটা! ত‌বে সব‌চে‌য়ে বিব্রতকর রু‌বিনার বাবা কামাল আহ‌মে‌দের জন্য। মা‌ঝে মা‌ঝে তা‌ঁ‌কে দে‌খেই মন্তব্য ক‌রে- কী‌রে কামাল ঘ‌রে বউ রে‌খে বাই‌রের মে‌য়ে‌দের সা‌থে গাল-গল্প ক‌রিস, না! নানা ছু‌তোও মে‌য়ের বয়সী মে‌য়ে‌দের গা‌য়ে হাত দিস বদমাশ। নারী ক‌ণ্ঠের এমন কথার পর পুরুষ ও নারী কণ্ঠ স‌ম্মি‌লিতভা‌বে হাস‌তে থা‌কে এবং এ সবই রু‌বিনার কণ্ঠ থে‌কেই বের হ‌তে থা‌কে!
রওশন আরা মে‌য়ের এমন সুস্থ-স্বাভা‌বিক আচর‌ণে অত্য‌ধিক আন‌ন্দিত। ‌তি‌নি আনন্দ গোপন ক‌রে মে‌য়ে‌কে ব‌লেন-
রুবিনা মা এত সকাল সক‌াল ঘুম থে‌কে ও‌ঠে‌ছো যে?
আ‌মি তো ‌রোজ সকালই ও‌ঠি মা।
আজ‌কে শরীরটা কেমন লাগ‌ছে মা?
ভাল মা। কিন্তু এমন প্রশ্ন কেন কর‌ছো মা? আ‌মি কি অসুস্থ! তোমরা‌ কি আমা‌কে অসুস্থ ম‌নে কর?
না মা তা কেন হ‌বে! তু‌মি তো সুস্থই। ত‌বে কয়‌দিন কেমন যেন অ‌স্থিরতার ম‌ধ্যে ছি‌লে না! বেশ ক‌য়েকবার অজ্ঞানও হ‌য়ে গি‌য়ে‌ছি‌লে।
কই মা আ‌মি তো ম‌নে কর‌তে পা‌রি না! কখন অজ্ঞান হলাম?
ঠিক আ‌ছে মা। এগু‌লো এখন না শুন‌লেও চল‌বে।‌ তুমি ঘ‌রে গি‌য়ে বিশ্রাম নাও। আমা‌কে সাহায‌্য করা লাগ‌বে না।
প্লিজ মা। একটু কাজ ক‌রি। তাছাড়া তোমরা আমার সা‌থে কেমন আচরণ যেন কর‌ছো! ম‌নে হ‌চ্ছে যেন আ‌মি অ‌নেক অসুস্থ!
রু‌বিনার এমন কথায় রওশন আরা হকচ‌কি‌য়ে যান। মে‌য়ের সা‌থে আর কথা না বা‌ড়ি‌য়ে কা‌জে মন‌যোগ দেন।

চলবে…..

জানুয়ারি ৯, ২০২৫

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *