মধ্যরাতের অশরীরী আততায়ী
মধ্যরাতের অশরীরী আততায়ী
শাহীনুর আসিফ
বিন্দুবাসিনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। চৈত্রের কাঠফাটা গরমের দুপুরে প্রধান শিক্ষক আবদুর রহমান বিদ্যালয়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এ মুহূর্তে তিনি বেশ চিন্তিত। গত কয়েকদিন ধরে স্কুলের কিছু কিছু শিক্ষার্থী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। গতকালকেও পঞ্চম শ্রেণির বেশ কিছু ছাত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। অজ্ঞান হওয়ার আগে তারা সবাই একসাথে কোরাসে সুর করে কোনো অদ্ভুত ভাষায় গান গাইছিল। চেনা-জানা পৃথিবীর কোন ভাষার সাথে এই ভাষার কোন মিল নেই! সবার ঠোঁটের কোণে ছিল বিদঘুটে হাসি। জ্ঞান হারানোর আগে সবার মুখে শেষ কথা ছিল, মৃতপুরী হবে মৃতপুরী। এই শহরটা একটা মৃতপুরী হবে। প্রত্যেকের কণ্ঠ ছিল অন্যরকম। সুস্থ-স্বাভাবিক সময়ে যেমন থাকে তেমন নয়। কেমন যেন ধাতব কণ্ঠ, ভারী গলায় কথা বলছিল সবাই! তারপর পরই সবাই সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
আবদুর রহমান সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে উদাস নয়নে আকাশের দিকে তাকান। পরিষ্কার স্বচ্ছ নীল আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। কেমন যেন খা খা করছে চারপাশ। লু হাওয়া বইছে পুরো শহরে। অশুভ কিছু যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করছে পুরো শহরকে। কেউ মনে হয় আর রেহাই পাবে না সেই পিশাচের হাত থেকে! রহমান সাহেব নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আফসোসে মাথা নাড়েন। তাঁর এই শংকার কথা তিনি কাউকেই বলতে পারছেন না। কোনো পদক্ষেপও নিতে পারছেন না। তাহলেই পত্রিকায় নিউজ বের হয়ে যাবে- “কুসংষ্কারাচ্ছন্ন একজন প্রধান শিক্ষকের কাজ।” এই শিরোনামে। আবদুর রহমান সাহেব সকাল থেকে অপেক্ষায় আছেন। বিভাগীয় শহর থেকে একটা মেডিকেল টিম আসবে এই স্কুলে। তারা অজ্ঞান হওয়া ছাত্রীদের শারীরিক পরীক্ষা করবে। এছাড়াও মেডিকেল টিম পুরো স্কুলের স্টুডেন্টদের ওপর মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। স্কুলের বাচ্চাগুলোকে এজন্য বসিয়ে রাখা হয়েছে। রহমান সাহেব হাত ঘড়ি দেখেন। ঘড়িতে কাটায় কাটায় দুপুর দুইটা বাজে। তিনি একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন। ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর খিদে লেগেছে বোধ হয়। বেলা তো কম হল না। তিনি ব্যতি-ব্যস্ত হয়ে পায়চারি শুরু করেন স্কুল-বারান্দার এমাথা ওমাথা। ঠিক তখনই তিনি দেখতে পান একটা মাইক্রোবাস স্কুলের মেইনগেট দিয়ে ঢুকে বিশাল মাঠের বুক চিরে এগিয়ে আসছে প্রশাসনিক ভবনের দিকে।
আবুল হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাকে কালিগঞ্জ বাজার সংলগ্ন মসজিদের টয়লেট থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তার মাথাটা কমোডের ভেতর গোঁজা অবস্থায় ছিল। যেন খুব শক্তিশালী কেউ জোর করে তার মাথাটা কমোডের ভেতর চেপে ধরেছিল। চোখগুলো কোটর থেকে বের করে ফেলেছে কেউ। বুকের মাঝ বরাবর চিরে হৃদপিন্ডটা বের করে ফেলেছে কেউ প্রবল আক্রোশে! খুব শক্তিশালী কেউ যেন আবুল হোসেনের গলার হাড়টা ভেঙ্গে ফেলেছে। কমোড থেকে তার মাথাটা তোলার পরে মাথাটা একদিকে কাত হয়ে পড়েছিল। টয়লেটের ভেতরে এমন নির্মম একটা হত্যাকান্ড ঘটলেও এর দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। সকালের পরে দরজা ভেঙ্গে আবুলের লাশটা বের করা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবুলের লাশটা পোস্টমর্টেমের জন্যে নিয়ে যাওয়া হবে। এদিকে সবুরকে পাওয়া যায় রাস্তার পাশের একটা ধানক্ষেতের মধ্যে। ওর মুখটা ক্ষেতের কাদা-পানির মধ্যে গোঁজা অবস্থায় ছিল। প্রথম অবস্থায় তাকে মৃত মনে করা হলেও হাসপাতালে নিয়ে আসার পর সে জ্ঞান ফিরে পায়। সবুর পুরোপুরি সুস্থ হলে তাকে ঘটনা সম্পর্কে বিশদ জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
বিভাগীয় শহর থেকে আসা মেডিকেল টিম ইতিমধ্যে সেন্সলেস হওয়া প্রত্যেকটা ছাত্রীকে পরীক্ষা করেছে। বিকালের শেষ দিকে তারা হেডস্যারের রুমে আসে। উদ্দেশ্য অজ্ঞান হওয়া ছাত্রীদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ব্রিফ করা। সেখানে মিডিয়ার কয়েকজন সাংবাদিকও রয়েছে। মেডিকেল টিমের প্রধান ডাঃ সামিরা বলতে শুরু করেন:
আমরা অসুস্থ হওয়া প্রতিটি ছাত্রীর সাথে কথা বলে এবং তাদের শারীরিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছি যে আক্রান্ত সকল ছাত্রী ম্যাস হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত।
ম্যাস হিস্টিরিয়াটা কী?
প্রশ্ন করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুর রহমান সাহেব।
মাইক্রোফোনটা একটু ঠিক করে নিয়ে ডাক্তার সামিরা বলেন-
ম্যাস হিস্টিরিয়া বা গণমনস্তাত্বিক অসুস্থতা হল এমন একটা অসুখ যেখানে একজনের দেখাদেখি অন্যরাও হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হয়। ছেলেদের তুলনায় এ রোগে মেয়েরাই বেশি আক্রন্ত হয়। সাধারণ দৃষ্টিতে এটা ভয়ংকর মনে হলেও এটা আসলে একটা মানসিক রোগ।
আমাদের স্কুলের সব মেয়েরা তো সুস্থ সবল ছিল! হঠাৎ কেন তাদের এমন সমস্যা দেখা দিল?
প্রশ্ন করেন স্কুলের গণিত শিক্ষক দেবাশিষ বড়ুয়া।
দেখুন আমাদের সমাজে শিশুরা বর্তমানে নানা রকম ঝক্কি-ঝামেলা, মানসিক চাপ, পারিবারিক অশান্তি আর সামাজিক নিগ্রহের স্বীকার হয়। এক সময় তাদের ছোট্ট শিশুমন বিদ্রোহ করে বসে। অদমিত ব্যথা প্রকাশ পায় দৈহিক লক্ষণে।
কিন্তু স্কুলের সবাই কেন আক্রান্ত হবে?
কিছুটা উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করেন প্রধান শিক্ষক।
প্রথমে একজন আক্রান্ত হলে দেখাদেখি অনেকে আক্রান্ত হয়। প্রথমজনের হয়তো আগে থেকেই হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকে। আমরা জিজ্ঞাসা করে জেনেছি এখানের ঘটনাও তাই। পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার।
প্রথমজন কোনভাবে পারিবারিক নিগ্রহের স্বীকার হয়েছিল। এই স্কুলে প্রথমে যে আক্রান্ত হয়েছিল তার নাম রুবিনা। সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। সে হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পরই অন্যরা আক্রান্ত হয়।
সবাই কি এখন সুস্থ? ওদের বর্তমানে চিকিৎসা কী?
প্রশ্ন করেন বিজ্ঞান শিক্ষক আতাউর রহমান।
হ্যাঁ বলা যায় সবাই সুস্থ। শুধু রুবিনা ছাড়া। সে এখনও কেমন যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে। এই রেগের চিকিৎসা তেমন কিছু নেই। পর্যাপ্ত বিশ্রাম আর পুষ্টিকর খাবার দাবার খেতে হবে। আর সামান্যকিছু ওষুধ সেবন করতে হবে।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুর রহমান সাহেব বলেন-
আমার একটা কথা ছিল..
জি বলেন।
হেডস্যারের কথার মধ্যে কিছু একটা ছিল। যার কারণে একটু নড়েচড়ে বসেন ডা: সামিরা।
আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি বেশ কয়েকবার। আমার মনে হচ্ছে ওই স্বপ্নের সাথে এই ঘটনার কোন যোগসূ্ত্র আছে।
রহমান সাহেব আরো কিছু বলতে যান। কিন্তু তার আগেই তাঁকে থামিয়ে দেন ডাক্তার সামিরা।
আহা! স্বপ্ন তো স্বপ্নই। এর সাথে বাস্তবের মিল খুঁজতে যাওয়া বিরাট বোকামি। সাধারণত অগভীর ঘুমে আমার স্বপ্ন দেখি। সে সময়টাকে বলে রেপিড আই মুভমেন্ট। স্বপ্ন নিয়ে তাই মাথা ঘামানো ঠিক না। আমাদের আজকের ব্রিফিংটা এখানেই শেষ হচ্ছে।
কিন্তু ম্যাডাম..
হেডস্যারকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ব্রিফিং শেষ করে মেডিকেল টিম কোন এক অজানা কারণে দ্রুত চলে যায়।
জেলার ছোট-খাটো পুলিশ হাসপাতালটায় বেশ কয়েকদিন থাকার পর সবুর এখন কিছুটা সুস্থ। ডিবি পুলিশ আর পিবিআইয়ের একটা সমন্বিত টিম কিছুক্ষণ আগে সবুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গিয়েছে। অবশ্য বেশ কয়েকদিনের চেষ্টায় আজকে সফল হয়েছে তারা। আজকের আগে অনেক চেষ্টাতেও সবুরের থেকে কোন কথা বের করতে পারেনি তদন্তটিম। সবুর শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে ওদের দিকে চেয়ে থেকেছে। আজকেই প্রথম সে কথা বলেছে মেডিকেল টিমের সাথে। তাদের কথোপকথন ছিল নিম্নরূপ-
তদন্ত কর্মকর্তা: সবুর আপনি কেমন আছেন?
জি আগের চেয়ে ভালো স্যার। তবে এখনও পুরো শরীরে ব্যথা স্যার।
আপনার ব্যথা এখনও কমেনি?
আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। তবে এখনও আছে।
আর কোনো সমস্যা?
মাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করে স্যার।
সবকিছু মনে রাখতে পারছেন?
জি স্যার।
পুরনো কথা মনে আছে আপনার? বিশেষ করে ঘটনার সময়কার?
অনেকটাই মনে আছে স্যার। তবে ঘটনার শেষ সময়কার তেমন কিছু মনে নেই।
আচ্ছা কী হয়েছিল আপনার সাথে একটু খুলে বলুন তো।
স্যার আমি আর সাজ্জাদ বসে ছিলাম ডিউটি স্পটে একটা টিস্টলের বেঞ্চিতে। আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে আবুল স্যার টাট্টিখানার দিকে যায়।
টাট্টিখানা মানে কী?
সরি স্যার টাট্টিখানা মানে টয়লেট। তো টয়লেটে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরেও স্যার ফিরে না আসায় আমাদের সন্দেহ হয়। আমরা দু’জন যখন এ ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিলাম ঠিক সেই মুহূর্তে স্যারকে দেখতে পাই। ওনি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে আমাদের দিকে আসতে থাকেন। মনে হচ্ছিল স্যার ভেসে ভেসে আসছেন! স্যারের চেহারার মধ্যে কেমন কঠিন একটা ভাব ছিল। তিনি আমাদের কাছাকাছি আসা মাত্র আমার দিকে তাকান একবার। তারপর কেমন যেন কর্কশ গলায় বলেন-সবুর আমার সাথে এসো একটু। মনে হল যেন স্যার আমার সাথে রেগে আছেন। স্যার খুব দ্রুত হাঁটছিলেন। যেন তিনি হাওয়ায় ভেসে ভেসে যাচ্ছিলেন। আমি অতি দ্রুত তাকে অনুসরণ করা শুরু করি। কিন্তু তার কাছাকাছি পৌঁছাতে কিছুতেই পারছিলাম না! আমি কয়েকবার ডাকও দেই কিন্তু স্যার কোন সাড়া দেয়নি। এভাবে কতক্ষণ চলেছি ঠিক মনে নেই। হঠাৎ দেখি স্যার রাস্তা থেকে নেমে ধানক্ষেতের মাঝ বরাবর হাঁটা শুরু করেছেন। আমিও স্যারকে অনুসরণ শুরু করি। কিছুদূর যাওয়ার পরে স্যার উল্টো ঘুরে আমার দিকে আসা শুরু করেন। আমার একদম কাছে এসে স্যার একবার আমার দিকে তাকান। অদ্ভুত সে চোখের চাহনি। যেন মরা মাছের চোখের মত ভাবলেশহীন। তিনি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে তার চোখের মণি। কেমন যেন হিংস্রক্রোধে বের হয়ে আসতে চাইছে সে চোখ। এমন সময় তার ঠোঁটের কোণে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে। কেমন কর্কশ গলায় আবুল স্যার বলেন- আমার সাথে এসে বড্ড ভুল করেছিসরে সবুর। তোর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আবুল স্যারের চোখগুলো যেন বড় হয়ে ঠিকরে বের হতে চাইছিল তখন। তিনি তখন একটু কাছে এসে খপ করে আমার এক হাত চেপে ধরেন। অসম্ভব গরম ছিল সে হাত! গরমে মনে হচ্ছিল আমার সমস্ত শরীর পুড়ে যাবে! আমাকে তিনি এক ঝটকায় নিচে ফেলে দেন। মনে হল যেন অসম্ভব শক্তিশালী কিছু! তারপর আমার মাথাটা ধরে ক্ষেতের কাদা-মাটির মধ্যে চেপে ধরেন। মনে হল এই বুঝি জীবনের শেষ! নিঃশ্বাস নিতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল। ততক্ষণে আমার মুখের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে ক্ষেতের নরম কাদামাটি। যখন জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছি ঠিক তখনই দূর থেকে আজান ভেসে আসে। মসজিদে ফজরের আজান দিচ্ছে। অর্থাৎ সকাল হয়ে গিয়েছে প্রায়। সাথে সাথে আমি ভারমুক্ত হয়ে পড়ি। ভয়ংকর শক্তিশালী কিছু যেন আমার শরীরটা ছেড়ে দেয়। কিন্তু আমার শরীর এতো দুর্বল ছিল যে এর কিছুক্ষণ পরেই আমি জ্ঞান হারাই।
চলবে…….