অক্টোবর ২৭, ২০২৪

মধ্যরা‌তের অশরী‌রী আততায়ী

0

মধ্যরা‌তের অশরী‌রী আততায়ী

শাহীনুর আসিফ

আবুল হো‌সেনের খুব টেনশন হ‌চ্ছে। টেনশ‌নের কার‌ণে ইতিম‌ধ্যে সে দু’বার প্রকৃ‌তির ডা‌কে সারা দি‌য়ে‌ছে। এখন তৃতীয়বা‌রের মত সারা দেওয়ার প্র‌য়োজন বোধ কর‌ছে সে। অবশ্য আবুল হোসে‌নের টেনশ‌নেরও য‌থেষ্ট কারণ আছে। সে কারণটা ভয়ংকর। আবুল হো‌সেন পু‌লি‌শের একজন কন‌ষ্টেবল। আজ রা‌তে তার ডিউ‌টি প‌ড়ে‌ছে শহ‌রের নির্জন একটা জায়গায়। ভার‌তের সীমান্ত‌ঘেষা ছোট এই শহরটা এম‌নি‌তে বেশ শান্ত-‌শিষ্ট। শহ‌রের মানুষজন খুব শা‌ন্তি‌প্রিয়। মারামা‌রি, খুনখারা‌বি এই শহ‌রে নেই বল‌লেই চ‌লে। শহ‌রের বে‌শিরভাগ মানুষই মধ্য‌বিত্ত। এদের অধিকাংশই ছোটখা‌টো ব্যবসা, মাছচাষ আর চাক‌রি ক‌রে জীবন-যাপন ক‌রে। স্বল্প জনসংখ্যার এই শহর সারা‌দিন কর্মচঞ্চল থাক‌লেও সন্ধ্যার পর থে‌কে নীরব-নিস্তব্ধ হ‌য়ে যায়। অথচ এমন একটা জায়গায় খু‌নের ঘটনা ঘ‌টে চ‌লে‌ছে বেশ কিছু‌দিন ধ‌রে। সবগু‌লো খু‌নের ঘটনাই ঘ‌টেছে মধ্যরা‌তে। আর খুন হওয়া লাশগু‌লো পাওয়া যায় বীভৎস অবস্থায়। লা‌শের চোখগু‌লো উপড়ে ফেলা হয়। জিহবা মু‌খের বাই‌রে ঝুলন্ত অবস্থায় থা‌কে। লা‌শের পাঁজর আড়াআ‌ড়িভা‌বে কে‌টে কেউ যেন হৃদ‌পিন্ডটা বের ক‌রে ফে‌লে। এই পর্যন্ত যতগু‌লো হত্যাকান্ড ঘ‌টে‌ছে সবগু‌লো গভীর রা‌তে ঘ‌টে‌ছে। ভিক‌টিম সবাই সাধারণ খে‌টে খাওয়া মানুষ আর ফুটপা‌তের বা‌সিন্দা। হত্যাকা‌ন্ডের শিকার প্র‌তি‌টি মানুষ হয়‌তো সারা‌দি‌নের কাজ শেষ ক‌রে কেউ গভীর রা‌তে বাসায় ফির‌ছিল অথবা সহায়-সম্বলহীন কোন মানুষ ফুটপা‌তে ঘু‌মি‌য়ে ছিল। তখনই তা‌দের ওপর আক্রমন করা হ‌য়ে‌ছে। শহ‌রে নতুন আসা কোন দস্যুদল হয়‌তো এমন ঘটনা ঘটা‌চ্ছে। অন্তত পু‌লি‌শের তাই ধারণা। যে‌হেতু সীমান্ত শহর তার ওপর আবার শহ‌রের প্রান্ত দি‌য়ে ব‌য়ে গি‌য়ে‌ছে একটা নদী। তাই সীমা‌ন্তের ওপার থে‌কে নদী পে‌রি‌য়ে এসে হত্যাকান্ড ঘ‌টি‌য়ে আবার ফেরত যাওয়া সহজ দস্যু‌দের জন্য। অন্তত পু‌লি‌শের তাই ধারণা। ‌কিন্তু হতদ‌রিদ্র এসব নিরন্ন মানুষগু‌লো‌কে কেন হত্যা কর‌ছে? কী তা‌দের উদ্দেশ্য ? আবার সবগু‌লো হত্যাকা‌ন্ডের ধরণ একদম একই রকম কেন? এসব দ‌রিদ্র মানুষগু‌লোর থে‌কে টাকা-পয়সা বা মূল্যবান কিছু ছি‌নি‌য়ে নেওয়া তা‌দের উদ্দেশ্য না। কারণ ভিক‌টিম‌দের কেউই ধনী নয়। তাহ‌লে কেন তা‌দের হত্যা করা হ‌চ্ছে? এসব প্র‌শ্নের কোন উত্তর মিলা‌তে পার‌ছে না পু‌লিশ প্রশাসন। পাওয়া যা‌চ্ছে না তেমন কোন ক্লু’ও। তাই প্র‌তি‌দিনই রহস্য আরো ঘ‌নীভূত হ‌চ্ছে। আর পু‌লি‌শের ওপরও চাপ বাড়‌ছে।
আবুল হো‌সেনের আজ‌কে ডিউ‌টি প‌ড়ে‌ছে মহাসড়‌কের পা‌শে একটা বাজারের সাম‌নে। জায়গাটা দিনের বেলা সরগরম থাক‌লেও সন্ধ্যার পর থে‌কে নীরব হ‌য়ে যায়। বাজারটা পে‌রি‌য়ে একটু সাম‌নে এগু‌লেই একটা মস‌জিদ। তার সা‌থে এখ‌া‌নে ডিউ‌টিতে আছে আরো দু’জন কন‌স্টেবল। একজ‌নের নাম সাজ্জাদ আর আরেকজ‌নের নাম সবুর। তিনজ‌নের ম‌ধ্যে আবুল হো‌সেন সি‌নিয়র। তারা তিনজন বাজা‌রের সাম‌নে টিস্ট‌লের বে‌ঞ্চি‌তে ব‌সে আছে। এখন বা‌জে রাত বা‌রোটা। টিস্টলটা এতক্ষণ খোলা থাক‌লেও কিছুক্ষণ আগে দোকানদার দোকান বন্ধ ক‌রে চ‌লে গি‌য়ে‌ছে। দোকান বন্ধ ক‌রে দেওয়ার কার‌ণে তা‌দের চারপাশটা এখন ঘুটঘু‌টে অন্ধকার। কাঁচা বাজারও বন্ধ হ‌য়ে‌ছে অনেকক্ষণ আগে। জনমানবশূন্য পু‌রো এলাকাটায় মা‌ঝে মা‌ঝে রা‌তের নিস্তব্ধতা‌কে ভে‌ঙ্গে দ্রুত‌বে‌গে চ‌লে যা‌চ্ছে গাড়ি। তখন হেডলাই‌টের আলোয় চারপাশটা একটু আলো‌কিত হয়। তারপর আবার নিরব নিস্তব্ধ আর অন্ধকার। য‌দিও ও‌দের তিনজ‌নের দলটার কা‌ছে একটা টর্চলাইট আছে। কিন্তু চার্জ শেষ হ‌য়ে যাওয়ার ভ‌য়ে তারা সেটা বে‌শিক্ষণ জ্বালা‌চ্ছে না। ‌চৈ‌ত্রের এই রা‌তের বেলাতেও হঠাৎ আবুল হো‌সে‌নের কেমন যেন শীত শীত লাগ‌ছে। তখনই সে চতুর্থবা‌রের মত প্রকৃ‌তির ডা‌কে সাড়া দেওয়ার প্র‌য়োজন অনুভব ক‌রে। সে তার সহকর্মী‌দের উদ্দে‌শ্যে ব‌লে-
এই সাজ্জাদ আর সবুর তোমরা একটু বসো কিছুক্ষণ। আমি একটু আস‌ছি।
‌কোথায় যা‌বেন স্যার? টা‌ট্টিখানায়? সবুর মিয়া টয়‌লেট‌কে টা‌ট্টিখানা ব‌লে। এ নি‌য়ে তার সহকর্মী‌দের কা‌ছে অনেকবার বকা খে‌তে হ‌য়ে‌ছে তা‌কে। আজও আবুল হো‌সেন ধমক দি‌য়ে ও‌ঠে।
সবুর তোমার বদঅভ্যাসটা ঠিক কর। আমার সাম‌নে আর কখ‌নো টা‌ট্টিখানা বল‌বে না। টয়‌লেট বল‌বে। ম‌নে থা‌কে যেন।
‌জি স্যার।
স্যার টা‌ট্টিখানা বল‌লে সমস্যাটা কোথায়? টা‌ট্টিখানা ব‌লেও তো একটা শব্দ আছে। জি‌জ্ঞেস ক‌রে সাজ্জাদ। তার বে‌শি কথা বল‌ার রোগ আছে। সব ব্যাপা‌রে তার কথা বলা চাই।
আ‌রে এতো কথা বল কেন?
আবার ধম‌কে ও‌ঠে আবুল। একে তো সে ভিত‌রে ভিত‌রে ভ‌য়ে ম‌রে যা‌চ্ছে, তার ম‌ধ্যে আবার ও‌দের যন্ত্রণা। ‌সে নি‌জে সি‌নিয়র হওয়ার কার‌ণে সহকর্মী‌দের বল‌তেও পার‌ছে না ভ‌য়ের ব্যাপারটা। আবার একা যে‌তেও মন সায় দি‌চ্ছে না। দু’জ‌নের ম‌ধ্যে থে‌কে অন্তত একজন তার সা‌থে এসে টয়‌লে‌টের সাম‌নে দাঁড়ি‌য়ে থাক‌লে ভয় কিছুটা কম‌তো। কিন্তু একথাটা আবুল হো‌সেন মুখ ফু‌টে বল‌তে পার‌ছে না সি‌নিয়র হওয়ার কার‌ণে। এদি‌কে তার প্রকৃ‌তির ডাক প্রবল থে‌কে প্রবলতর হ‌চ্ছে। কয়েক কদম সাম‌নে এগি‌য়ে গি‌য়ে সে আবার ফি‌রে আসে। তার সহকর্মী‌দের উদ্দেশ্য ক‌রে ব‌লে-
এই আমার শর্টগানটা তোমা‌দের কাছে রা‌খো। এইটা নি‌য়ে আমি টয়‌লে‌টে যা‌বো নাকি? তোমরা ম‌নে ক‌রে দি‌বে না!
স্যার আমরা ম‌নে করলাম আপ‌নি বোধহয় ভয় পা‌চ্ছেন। তাই শর্টগানটা সা‌থে রাখ‌তে চাই‌ছেন। জব‌াব দেয় সাজ্জাদ।
‌তোমা‌দের কী ম‌নে হয় আমি ভিতু? ভয় আমার ডিকশনারী‌তে নেই।
‌জি স্যার আমিও তাই ম‌নে ক‌রি।
ঠোঁ‌টের কো‌ণে হালকা একটু হা‌সি এনে ব‌লে সবুর। আবুল হো‌সেন তীক্ষ্ণ দৃ‌ষ্টি‌তে তাকায় সবু‌রের দি‌কে। বোঝার চেষ্টা ক‌রে সবুর ঠাট্টার ছ‌লে বল‌ছে না‌কি! তারপর সে আবার টয়‌লে‌টে যাওয়ার জন্য সাম‌নে এগি‌য়ে যায়। কিন্তু কী ম‌নে ক‌রে আবার ফি‌রে আসে। কিছুটা ল‌জ্জিত ভ‌ঙ্গি‌তে ব‌লে-
‌দে‌খি তোমা‌দের সা‌থের টর্চলাইটটা দাও। বে‌শি অন্ধকার আজ‌কে। ফোনের ট‌র্চের আলোতেও কাজ হ‌বে না।
সাজ্জাদ ব্যস্তসমস্ত হ‌য়ে টর্চলাইটটা এগি‌য়ে দেয়। তা নি‌য়ে আবুল হো‌সেন আবার হাঁটা শুরু ক‌রে। উদ্দেশ্য বাজারটা পে‌রি‌য়ে সাম‌নে হাইও‌য়ের পা‌শেই যে মস‌জিদ আছে সেটার টয়‌লেট।
স‌খিনা বেগমের মাঝরা‌তে কেন যেন ঘুম ভে‌ঙ্গে গি‌য়ে‌ছে। বা‌জে একটা স্বপ্ন দে‌খে‌ছে সে তার স্বামী আবুল‌কে নিয়ে। সে ঘ‌রের ডিম লাই‌টের আলোয় তার দুইপা‌শে শু‌য়ে থাকা ছে‌লে-‌মে‌য়ে‌কে একব‌ার দে‌খে নেন। তারপর আশ্বস্ত হ‌য়ে বা‌লি‌শের পা‌শে থাকা ‌ফোনটা নি‌য়ে তার স্বামীকে ফোন ক‌রে। বেশ ক‌য়েকবার রিং হওয়ার প‌রে আবুল ফোন রি‌সিভ ক‌রে।
হ্যা‌লো এত রা‌তে কেন ফোন দিলা স‌খিনা?
স‌খিনা বেগম কিছুক্ষণ চুপ ক‌রে থে‌কে উত্তর দেয়। ত‌বে এই চুপ ক‌রে থাকার সময়টায় সে ফুঁ‌পি‌য়ে কাঁদ‌ছিল। আবুল এ প্রান্ত থে‌কেও বিষয়টা টের পায়।
‌জি খোয়াব দেখ‌ছি । আপনা‌রে নিয়া খুব খারাপ খোয়াব।

চলবে….

অক্টোবর ২৭, ২০২৪

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *