বরাদ্দ
বরাদ্দ
আরাফাত আহমেদ রিফাত
অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি।
এবারের ছুটিটা আর হুটকরেই নিতে হয়নি, তাই অফিসের কাজ গুলো গুছিয়ে রেখে আসতে পেরেছি। একসপ্তাহ একদম নিশ্চিন্তে থাকব। গতবারের মতো আর ঝামেলা হবে না এবার।
বড়ো বড়ো ইমারত পেছনে ফেলে ছুটে যাচ্ছে বাস। অবশ্য ছুটে যাচ্ছে বলা যাবে না, হেঁটে যাচ্ছে বলতে হবে। কারণ রাস্তায় প্রচুর জ্যাম, গাড়ি চলছে মন্থর গতিতে। টেলিভিশনে, সংবাদপত্রে বলা হচ্ছে এইসব জ্যামের প্রধান কারণ দেশের চলমান উন্নয়ন কাজ। উন্নয়ন না অবনতি তা বুঝতে পারি না। কারণ এইসব কাজ গত কয়েকবছর ধরেই চলছে, ফলাফল জনগণের ভোগান্তি।
বাসের সুপারভাইজারের কপালে চিন্তার ভাঁজ। গাড়ির অর্ধেক সিটই ফাঁকা। এইসব সিটের যাত্রী কাউন্টারে কল করে অগ্রিম বুকিং দিয়ে রেখেছে। সবাই তাদের সুবিধাজনক স্থান থেকে গাড়িতে উঠবে। যাত্রীরা সবাই সেইসব স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। কাউন্টার থেকে বেঁধে দেওয়া সময় পার হয়ে গেছে অনেক আগেই। দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা সুপারভাইজারকে কলের উপর কল করছে। অনেকে এমন হুমকিও দিচ্ছে যে ‘আগামী পাঁচ মিনিটের ভেতর বাস না আসলে তারা অন্য বাসে চলে যাবে।’
সুপারভাইজার এমন হুমকির তোয়াক্কাও করত না যদি যাত্রীরা বুকিং দেওয়ার সময় অগ্রিম ভাড়া পরিশোধ করত। কিন্তু সেটা যেহেতু হয়নি, সেহেতু সুপারভাইজারের কপালের চিন্তার ভাঁজ জ্যামিতিক হারে বাড়বে।
আমার অবশ্য অতো তাড়া নেই। যেহেতু একবার গাড়িতে উঠেছি সেহেতু বাড়িতে পৌঁছাবই, হোক সেটা কিছুটা দেরিতে। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন,
‘আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না; আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে, পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না: আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে নক্ষত্রের নিচে।’
‘হালার সরকার’ সুপারভাইজারের কণ্ঠে ক্ষোভ। ‘কাজ করবি তো এক-এক কইরা কর। একলগে সব কাজ করলে মাইনষে যাব কেমনে? গাড়ি ঘোড়া যাওয়ার জন্য তো একটা সাইড খালি রাইখা দিবি। এতো তারাতাড়ি তো ডিজিটাল হওয়ন যাইব না। হালার, আমার মতো মূর্খ মাইনষের মাথাত এই চিন্তা আইলে তগো মতন শিক্ষিত মাইনষের মাথাত এই চিন্তা আহে না?’
বোঝা গেল দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা ফোনে তাকে অনেক কথা শুনিয়েছে, এখন সে এই ক্ষোভ ঝাড়ছে সরকারের উপর। সবদিক থেকে মন সরিয়ে ব্যাগ থেকে হারুকী মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’ বইটা বের করে পড়তে শুরু করলাম। বইটা গত সপ্তাহে বইমেলা থেকে কিনেছি, কিন্তু অফিসের কাজের চাপে আর পড়া হয়নি।
মোটামুটি দুই ঘণ্টা পর বই থেকে চোখ সরিয়ে নিজেকে টঙ্গীতে আবিষ্কার করলাম। বাসটি এখনো গাজীপুর পৌঁছায়নি। প্রচুর জ্যাম। ড্রাইভার বাসের ইঞ্জিন বন্ধ করে রেখেছে। মিনিট দশেক পর জ্যাম ছাড়ল। বাস আবার চলতে শুরু করল। আমিও আবার বই পড়তে শুরু করলাম।
জয়দেবপুর চৌরাস্তায় এসে আবারও বাস থামল। এবার অবশ্য সামনে জ্যাম নেই। ড্রাইভার বাস থেকে নেমে রাস্তার উলটো পাশে চলে গেল। কেউ কিছু বুঝতে পারলনা। অমি অবশ্য ভাবলাম ‘ড্রাইভারের বুঝি প্রকৃতির ডাক দিয়েছে।’ পেছনের সিটে বসা একজন যাত্রী বলল, ‘কিরে মামা, ওস্তাদের ডায়াবেটিস আছে না-কি রে? এতক্ষণ জ্যামে বসে থাকলাম, তখন গেলেই তো হতো। আবার কখন জ্যাম বাঁধবে তার ঠিকঠিকানা নেই!’
বাস চালক খুব দ্রুতই রাস্তার ওপাশ থেকে ফিরে এলো। হাতে একটা গোলাপ। গোলাপটি ককপিটের সামনে রেখে আবার বাস চালাতে শুরু করল। গোলাপ দেখেই হঠাৎ মনে পড়ল ‘আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবস।’
ড্রাইভারকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখলাম। চলন্ত অবস্থায় বাসের চালকের সাথে কথা বলা ঠিক নয়।
মাওনার কাছে আসতেই আবার জ্যামে পড়ে বাস। এবার অবশ্য কৃত্রিম জ্যাম নয়, প্রাকৃতিক জ্যাম। বাস আর ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে অনেক আগে। এখন ক্রেন দিয়ে সেগুলো সরিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করা হচ্ছে।
ভাবলাম এবার অবশ্য চালকের সাথে কথা বলা যায়। ‘ড্রাইভার মামার নাম কী?’ জিজ্ঞেস করলাম।
পেছনে ঘুরে দেখার চেষ্টা করল যে প্রশ্নটা কে করল। তারপর উত্তরে বলল, ‘হারুন।’
‘তা মামা, দেখলাম ফুল কিনে আনলে, ঘটনা কী? প্রেম টেম করো না-কি?’
হারুন আমতা আমতা করে বলল, ‘প্রেম একটা করি।’ বুঝতে পারলাম ছেলেটা খুব লজ্জা পেয়েছে। ‘ওর লগে আমার বিয়াও ঠিক হইছে। আইজকা বলে ভালোবাসা দিবস। আমি তো গাড়িত, ছুডি পাইনাই। ওর কথা ভাইবা ফুল কিনছি।’
এতটুকু বলে কিছুটা থামল। তারপর আবার বলল, ‘পরে ভাবলাম ওর পরে এই গাড়িডারে বেশি ভালোবাসি। তাই ওর কথা ভাইবা ফুলডা গাড়িরেই দিলাম।’ কথাগুলো শুনে খুব ভালো লাগল।
দিনশেষে সবাই আমরা ভালোবাসার কাঙ্গাল। শত ব্যস্ততার মাঝেও একটুখানি সময় আমরা বরাদ্দ রাখি ভালোবাসার মানুষটির জন্য। সে ড্রাইভার হারুনই হোক বা চাকুরে রাতুলই হোক।