ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

পৈতাধারী ভোম্বল

0

পৈতাধারী ভোম্বল

অরবিন্দ সরকার

ভোম্বল দাস,ঢাক বাজায়, পূজা পার্বনে।তার ইচ্ছা পুরোহিত হ’য়ে পূজার্চ্চনা করার। চারিদিকে বামুনের আকাল।বামুনদের মধ্যে ভট্টাচার্য,রায়, ও চক্রবর্তী উপাধি তাঁরা পূজা করেন। গ্রামে ঢাক বাজিয়ে তেমন লাভ নেই। শহরে তবুও ভালো পয়সা মেলে। সরস্বতী পূজায় বামুন সেজে শহরে অনেক পূজা গতবার করেছে। অলিতে গলিতে সরস্বতী পূজা। ফেল করা, বখাটে ছেলেদের মাতৃ আরাধনা।ন্যেংটি ধরে টানাটানিতে একেবারে বেইজ্জত হতে হয়েছিলো। সরস্বতী পূজায় গতবার প্রায় সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে ত্রিশ হাজার টাকা বাগিয়েছে। শুধুমাত্র একটি সরস্বতীর পূজা মন্ত্র বই কিনে। ঢাক বাজিয়ে হয়তো পাঁচ হাজার টাকা জুটতো! ভোম্বলের সংসারে স্বাচ্ছল্য এসেছে এবার। ভোম্বলের স্ত্রীর ইচ্ছা বামনী সেজে ভোগ রান্না করার। তাহলে দুজনের আয়ে ঘর দোর রঙ করা যাবে। ভোম্বল দাস সরকারি সাহায্যে পাকা বাড়ি পেয়েছে, এবার তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে গ্রামের মোড়লদের মতো করতে চায় সে।
ভোম্বলের মন্ত্রপাঠ কেউ তেমন শুনতে পাই না কিন্তু পুষ্পাঞ্জলি দেবার সময় মাইকে জোরে জোরে বই দেখে দেখে উচ্চারণ করে।কারণ ওখানে বাড়তি আয়। যতো জন পুষ্পাঞ্জলি দেবে সবার দশ টাকা করে গ্যাঁটে গুঁজে রাখবে ।
এবার দুর্গার আরাধনার বই কিনে এনেছে। বাড়ীতে পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রটা মুখস্থ করে নিয়েছে।
নির্দিষ্ট পুজোর আগের দিন ভোরবেলায় দুগ্গা দুগ্গা বলে বেরিয়ে পড়লো কলকাতার উদ্দেশ্যে, বাড়ীতে ভোম্বলের শাশুড়িকে রেখে।বেলা দশটায় শিয়ালদহ পৌঁছে উদোম গায়ে মোটা পৈতা গলায় জড়িয়ে ঢাকের বাদ্যির আগে দাঁড়িয়ে পড়লো। ভোম্বলের মতো অনেক পৈতাধারী বামুন নিয়ে দরকষাকষি চলছে। দুর্গাপূজায় দুটো করে পুরোহিত দরকার হয়। বেশিরভাগ পৈতাধারী গাঁয়ের পুরুত ভোম্বলকে দ্বিতীয় পুরুত হিসেবে নিতে চায়! ভোম্বল বললো পুরুতের আবার প্রথম দ্বিতীয় কি? সব কিছুই সমান সমান। মালিকের দক্ষিনা,অঞ্জলির,ও ফলমূলের সমান সমান ভাগ। একজন বামুন ভোম্বলকে তাই দেবো বলে নিলো। শহরের এক গলিতে পুজা, রাস্তা ঘিরে পুজো মণ্ডপ। বৌ পিছে পিছে এলো। ভোম্বল বললো এই বৌটাকে নিয়ে এসেছি রান্না ও ভোগ তৈরি করে দেবে।পুজো কমিটি সোনায় সোহাগা। সব পেয়ে গেলেন। ভোম্বলের বৌয়ের চারদিনের ভোগ রান্না, মহাষ্টমীর ভোগ বিলি এসবের জন্য বরাদ্দ পঁচিশ হাজার টাকা। আর ভোম্বলদের দুজনের চল্লিশ হাজার ‌। বাড়তি আয় পুজো কমিটি হাফ হাফ নেবে। ভোম্বল চুপ করে রইলো,দেখলো তার ষোলো আনা লাভ। ফলগুলো পুজোর শেষে শিয়ালদাই বেচে আসবে প্রতিদিন। শেষের দিন বাড়ীর জন্য কিছু নিয়ে যাবে আর বাদবাকি বিক্রি করে দেবে এই পরিকল্পনা। খাওয়া দাওয়া সব মন্দির কমিটির। প্রতিদিন মায়ের ভোগ দুবেলা জোটে পুজোর শেষে, আর চা বিস্কুট ঘনঘন। এখন আগের দিনের মতো পুজো নয়। মুরুব্বী বসে বসে পুজো দেখতেন ও মন্ত্রপাঠ শুনতেন। তাঁরা শিক্ষিত মানুষ, ভুল ধরে ফেলতেন,আর এখন অঞ্জলী দেবার সময় সব জড়ো আর অন্য সময়ে এদিক ওদিক ঘুরুঘুরু বেরিয়ে পড়ো।দশমীর দিন বিদায় বেলায় সব গুছিয়ে নিয়ে ভোম্বলেরা বের হবে তখন কয়েকটি পুজো কমিটির ছেলে ছোকরা এসে ভোম্বলকে বললো – ঠাকুর মশাই এই বোতলগুলো একটু মন্ত্রপূত করে দিন গঙ্গা জল ফুল দিয়ে। আর একটু যদি ফিতে কেটে দু পেগ্ সেবন করেন তাহলে আমরা কৃতার্থ হবো। ভোম্বল বললো নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। তবে একটা আমি বাড়ি নিয়ে যাবো বিলাতি আর দেশি পেগে নয়,দু’ গ্লাস খেয়ে বের হবো। সামনে বার একটু দক্ষিণা বাড়াবেন তাহলে এখানেই আসবো। পুজো কমিটির লোকজন বললো ঠিকানা দিন, আমরা আপনার গ্রামে পৌঁছে বায়না দিয়ে আসবো। ভোম্বল দেখলো মহাবিপদ। ভোম্বল এর বৌ সাবিত্রী বললো উনাকে বাড়িতে তেমন পাবেন না। প্রায় প্রতিদিনই পুজো পার্বন লেগেই আছে। উনি বাড়ীতে কম থাকেন। পুজো কমিটির ছেলেরা বললো তাহলে ফোন নাম্বার দিন, ফোন করেই যাবো? ভোম্বল বললো আপনাদের ফোন নম্বর দিন, আমি বাড়ি গিয়ে ছেলের ফোনে ফোন করে সব বলবো।
ভোম্বল পুজো কমিটির সভাপতির ফোন নম্বর নিয়ে, বাড়ির পথে রওনা দিলো। ট্রেনে উঠে বৌকে বললো টাকাগুলো কিন্তু সব আমার। তোমার তো লক্ষ্মীর ভাঁড়ার আছে, আমার তো নেই? বৌ বললো যার যেমন কাজ ,তার তেমন মজুরি। ভোম্বল – আর তোমাকে কোলকাতায় নিয়ে আসবো না? ভোম্বলের বৌ বললো আমি সব চিনে ফেলেছি, তাছাড়া ঠাকুরপোরা কি ভালো ছেলে! আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো বৌদি তোমাকে আসতেই হবে! ভোম্বল – এতো কীর্তি ঘটেছে তোমার এখানে? আমি টের পেলাম না কিছুই। আমি মন্ত্র পাঠে আর তুমি বিপথের পথে ঘাটে? চলো বাড়ি,এর বিচার হবে? সাবিত্রী বললো – বিচার তোমার হবে,মোড়লেরা যখন জানবে তুমি পুরোহিত সেজে পুজো করেছো, তাহলে মেরে তোমাকে তক্তা বানাবে? আমার কি? ভোম্বল বললো ঠিক আছে এনিয়ে বেশি না কচলানোই ভালো। তবে বাড়ীর বারান্দায় বসে বিলাতি মদ খাবো। মোড়লেরা দেখুক আমরাও বিলাতি খাই মাঝে মাঝে। ইনকাম করে খাই, কারো বাপের টাকায় খাইনা? সাবিত্রী বললো -আস্তে আস্তে, বাতাসের কান আছে। তুমি হয়তো মদ খেয়ে সব বলে দেবে? নেশায় কিনা হয়- ঘরের বৌকে মা বলে। ভোম্বল বললো – তাহলে দরজা বন্ধ করে দুজনেই একটু একটু করে মায়ের প্রসাদ খাবো। প্রসাদী বললো- আমি তো রয়েছি ঠাকুরের প্রসাদী!

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *