অক্টোবর ২৭, ২০২৪

ঝিনাইগাতী উপজেলার নদনদী

0

ঝিনাইগাতী উপজেলার নদনদী

আইয়ুব আকন্দ বিদ্যুৎ

পূর্বকথা : ঝিনাইগাতী উপজেলা পূর্বে নালিতাবাড়ি উপজেলার অংশ ছিল। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে নালতাবাড়ির পাঁচটি ইউনিয়ন, যেমন- কাংশা-ধানশাইল,নলকুড়া-গৌরীপুর, হাতিবান্ধা- মালিঝিকান্দা ও ঝিনাইগাতী পৃথক করে একটি আলাদা থানা সৃষ্টি করা হয় যা ১৯৮৩ সালে উপজেলায় উন্নীত হয়। মূলত থানা সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে ঝিনাইগাতীর বিভিন্ন পরিসংখ্যান নতুন ও আলাদা করে হিসার করা হয়। সেজন্য বিভিন্ন নদীরও আলাদা হিসাব করা হয়।দেখা যায় বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তের উত্তরে ভারতের মেঘালয় থেকে দক্ষিণ দিকে ভারত -বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের শ্রীবর্দি উপজেলার ওপর দিয়ে সোমেশ্বরী,ঝিনাইগাতী উপজেলার ওপর দিয়ে মহারশি,কালাঘোষা এবং নালিতাবাড়ি উপজেলার ওপর দিয়ে ভোগাই ও চেল্লাখালি নামে পাঁচটি আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে নকলা ও শেরপুর উপজেলার দক্ষিণ পার্শ্ব দিয় পূব দিকে প্রবাহিত হওয়া ব্রহ্মপুত্র নদীতে পতিত হয়েছে যাদের মধ্যে তিনটি আন্তর্জাতিক নদীই ঝিনাইগাতী উপজেলার সীমানার মধ্যে সমাপ্ত হয়েছে নদী তিনটি হলো মহারশি, কালাঘোষা এবং সোমেশ্বরী নদী।

ঝিনাইগাতী উপজেলার ছয়টি নদী :

ঝিনাইগাতী উপজেলার ওপর দিয়ে ছয়টি নদী প্রবাহিত হয়ে অবশেষ একটি মাত্র নাম ধারণ করে দক্ষিণ দিকে ব্রহ্মপুত্র নদীতে পতিত হয়েছে অথবা কোথাও কোথাও নাম পরিবর্তনও হয়েছে। পরে ব্রহ্মপুত্রের ধারা ভৈরবে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়ে মেঘনা নামেই বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। ঝিনাইগাতী উপজেলার ছয়টি নদীর মধ্যে মহারশি, কালাঘোষা এবং সোমেশারী নদী তিনটি আন্তর্জাতিক নদী এবং পাগলা, মালিঝি ও ডাকুরী নদী তিনটি আঞ্চলিক নদী। তবে বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত ৫৪ টি নদীর মধ্যে মহারশি নদীর নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি যা তালিকাভূক্ত করার জোরালো দাবি জানাই। তিনটি আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্য কালাঘোষা নদীরও নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি উইকিপিডিয়ায়। এই ছয়টি নদীর মধ্যে মহারশি, সোমেশ্বরী এবং মালিঝি নদী অধিক খ্যাতিমান। নিচে এই ছয়টি নদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো।

মহারশি নদী: মহারশি নদী উত্তরে ভারতে মেঘালয় রাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিম গারো পাহাড় থেকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণমুখি প্রবাহী হয়ে ভারত- বাংলাদেশের উত্তর সীমানায় বাংলাদেশের শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার গারোকোণা /হলদিগ্রাম গ্রামের ভেতর দিয়ে ১১০৮ নং পিলারের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ক্রমান্বয়ে এঁকেবেঁকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে ঝিনাইগাতী উপজেলার বগাডুবি ব্রীজের প্রায় এক কি.মি. পূর্বে চতল নামক গ্রামের দক্ষিণে মালিঝি নদীতে মিলিত হয়েছে। পরে মহারশির ধারা মালিঝি নামে দুই কি. মি. দক্ষিণ পশ্চিমে পাগলার মুখ বাজারের নিকট এসে দিক পরিবর্তন করে দক্ষিণ পূর্বমুখি হয়ে দুই কি. মি.গিয়ে পাগলার পাড় গ্রামের কাছে দক্ষিণমুখি হয়ে প্রবাহিত হয়ে ক্রমশ দক্ষিণ দিকে সরে তিনানী বাজার অতিক্রম করে রাঙ্গামাটির পূর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে নালিতাবাড়ির গাগলাজানির কাছ দিয়ে আরো দক্ষিণে গিয়ে নকলা থানায় প্রবেশ করে। পরে মালিঝি নামধারী মহারশির ধারা নকলা উপজেলা পেরিয়ে দক্ষিণে পূর্বমুখি প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদীতে পতিত হয়। পরে মহারশির ধারার সমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রদত্ত মহারশি নদীর নম্বর ৬৮ এবং নদীর গড় প্রশস্ততা ৫৭ মিটার। নদীটি ভারতের মেঘালয়ের চিসিং পাড়া সীমান্ত ফাঁড়ির নিকট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। জানা যায় মেঘালয়ে মহারশি নদীর নাম মহাদেও, মহাদেবতা বা মহাঋষি। কালক্রমে এই মহাঋষি নাম পরিবর্তিত হয়ে মহারশিতে রূপান্তরিত হয়। সম্ভবত বাংলায় মুসলিম শাসনের কোন এক সময় এ নামের প্রচলন হয়। আবার মহারশি নদী বাংলাদেশ অংশে গারোকোণা/ হলদিগ্রাম থেকে ঝিনাইগাতী বাজারের দক্ষিণে খৈলকুড়া পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে প্রলয়ঙ্করী রূপ ধারণ করে যে সময় কোন বাহনে যথা নৌকা, ভেলায় বা সাঁতরিয়ে এ নদী পার হওয়া অসম্ভব। তখন এ নদীতে খেয়ানৌকাগুলো কোন অবস্থাতেই লোক বা অন্য কোন মালামাল পারাপার করতে পারতো না। এমন কি বর্ষা মৌসুমে এ নদী বেয়ে বড় বড় গাছ, বিভিন্ন মালামাল, ভেঙেপড়া ঘর, বস্তা, এমনকি মৃতদেহও ভেসে আসতে দেখা যায় যা নদী পাড়ের লোকেরা লাকড়ি সংগ্রহের উদ্দেশে ভেসে আসা ওইসব বৃক্ষ ও মালামাল নদী থেকে বড় বড় রশিতেও টেনে উদ্ধার করতে পারতো না। সম্ভবত এ কারণেও মহাঋষি নদীর নাম মহারশি হয়ে থাকতে পারে। ঝিনাইগাতী উপজেলার গারোকোণা থেকে ঝিনাইগাতী উপজেলার বগাডুবির পূর্বে চতল গ্রাম পর্যন্ত মহারশি নদীটি মহারশি নামেই প্রবাহিত এবং এ নদী সীমান্ত থেকে ঝিনাইগাতী বাজার পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে প্রচণ্ড খরস্রোতা। গোমরা থেকে মহারশি নদী দক্ষিণ পশ্চিম দিকে হলদিগ্রাম,সন্ধাকুড়া, রাংটিয়া নলকুড়া, শালচুড়া, ডাকাবর অতিক্রম করে প্রায় ৯ কি. মি এসে ঝিনাইগাতী বাজার লাগোয়া পূর্বপাশ দিয়ে দক্ষিণ দিকে খৈলকুড়া, দীঘির পাড়, রাম নগর, চলত অতিক্রম করে আনুমানিক আরো ৮ কি.মি. প্রবাহিত হয়ে মালিঝি নদীতে মিলিত হয। মহারশি নদীটি ভারতে ১০০ কিমি ও বাংলাদেশে মহারশি নামে প্রায় ১৭ কি. মি. এবং মালিঝি নামে প্রায় ৩৬ কি.মি. প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীতে পড়েছে। সেই হিসেবে বাংদেশে অংশে নদীটির ৫৩ কি. মি দৈর্ঘের প্রায় বেশির ভাগ মালিঝি নামে প্রবাহিত হলেও মহারশিই ঝিনাইগাতী উপজেলার প্রধান নদী। জানা যায় মহারশি নদী বাংলাদেশে প্রবেশের প্রারম্ভিক এলাকা গারোকোণা/ হলদিগ্রাম এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এই নদীতে রাংটিয়ায় একটি রাবার ড্যাম তৈরি করা হয়েছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত ১০ বছর পরেও এই নদীতে নৌকা চলাচল আমরা দেখেছি এবং পূর্বে এই নদীর নৌচলাচলে ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেছে ঝিনাইগাতীর মত বড় বাজার। মহারশি নদীর হলদে বালি যাকে লালবালি বলে ডাকা হয় তার কদর অনেক বেশি এবং শাদা বালির তুলনায় মূল্যও অনেক বেশি। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে লিজ নিয়ে অথবা না নিয়ে মহারশি নদী থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার বালি উত্তোলন করে নদীর পরিবেশ বিপর্জয় ঘটিয়ে নদী তীরবর্তী লোকজনদেরকে বিরাট এক হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এবং নদীর দুপাশে ব্যক্তিগত দখল বাড়িয়ে নদীকে আগের তোলনায় শীর্ণ করে ফেলা হচ্ছে যার কারণে নদীর দুপাড় ভেঙে বর্ষার সময় পাহাড়ি ঢল এসে হাজার হাজার একর ফসলি জমি ও ঘরবাড়ি ডুবে যায়। ইতোমধ্যেই এ নদীর ঝিনাইগাতী বাজার সংলগ্ন পূর্বতীরে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ একান্ত প্রয়োজন। তৎপরবর্তী এ নদীর লালবালিকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে একটি সিরামিক কারখানাও গড়ে তুলতে পারে সরকার। এদীর মাছ খুবই সুস্বাদু।

সোমেশ্বরী নদী : সোমেশ্বরী নদীটি একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ নদীর প্রবাহ ভারত বাংলাদেশ এই দুই দেশের ওপর দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে। সোমোশ্বরী ভারতের মেঘালয় রাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিম গারোপাহড়ের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত শেরপুর জেলার শ্রীবরদি উপজেলার বালিজুড়ি বাজারের উত্তরে খাড়ামুড়া গ্রামের ওপর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে শ্রীবরদি উপজেলার ওপর দিয়ে দক্ষিণ পূর্বগামী হয়ে শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলায় প্রবেশ করে ওই উপজেলার চতল নামক স্থানে মালিঝি নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। পরে মহারশি ও সোমেশ্বরীর মিলিত স্রোত মালিঝি নদী নামে নকলা উপজেলার দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদীতে পতিত হয়েছে। এ নদীর দৈর্ঘ্য বাংলাদেশ অংশে নিজ নামে ২৩ কি. মি. এবং প্রস্থ ৪৫ মিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রদত্ত নম্বর ৮৭. সোমেশ্বরী নদী শ্রীবরদি উপজেলা থেকে ঝিনাইগাতী উপজেলায় প্রবেশ করে ঝিনাইগাতীর কাংশা ইউনিয়নের আয়নাপুর বাজারের পশ্চিমে। পরে সেখান থেকে নদীটি ঝিনাইগাতী উপজেলার ওপর দিয়ে ক্রমশ দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। সোমেশ্বরী নদী ঝিনাইগাতীর নাচন মুহুরী পানবর,দুপুরিয়া ও বাগের ভিটা গজার মারি বিল ও ধলী বিল পর্যন্ত দক্ষিণমুখি ধারায় ভিন্ন নামে প্রবাহিত হয়ে আরো দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে কালিনগরের পশ্চিমে এসে পূর্বমুখি হয়ে আবার ওই সোমেশ্বরী নামেই কালি নগর, দাড়িয়ার পাড়, সুরিহারা গ্রাম অতিক্রম করে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে (৩/৪ কিলো) চতল নামক গ্রামের নিকট মালিঝি নদীর সাথে মিলিত হয়। এখানে সোমেশ্বরী নদী তার আপন নাম হারিয়ে মালিঝি নদী নামে ব্রহ্মপুত্র নদীতে পতিত হয়। সোমেশ্বরী নদী বাংলাদেশে প্রায় ২৩ কি. মি. তার নিজ নামে প্রবাহিত এবং প্রায় ৩৬ কি. মি. মালিঝি নামে প্রবাহিত। সোমেশ্বরী নদীর উজান দিকে বেশ খড়স্রোতা এবং ভাটির দিকে শান্ত। সোমেশ্বরী নদীতে ওজানে কোথাও কোথাও বালি উত্তোলন করে দুর্বৃত্তরা মানুষজনকে পরিবেশ বিপর্জয়ের মুখে পতিত করে। এ নদীতে বেশ সু্স্বাদু মাছ পাওয়া যায়। সোমেশ্বরী শেরপুর জেলার একটি আন্তঃসীমান্ত নদী হলেও এর কোন স্বীকৃতি মিলেনি অথচ নেত্রকোণা জেলায় এই একই নামে আরও একটি নদী আছে যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে। সেই জন্য শ্রীবরদি উপজেলা পরিষদে একটি মিলনায়তন কক্ষকে ” সোমেশ্বরী ” নাম করণ করা হলেও দূরবর্তী এলাকার লোকেরা এটাকে নেত্রকোণার সোমেশ্বরী মনে করে, যা অনভিপ্রেত। এমনকি নেত্রকোণা জেলার কোন কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক,লেখক মনে করে যে শেরপুর জেলায় সোমেশ্বরী নামে কোন নদীই নেই। তবে যারা এ অজ্ঞতায় ভোগে তারা এসে সরেজমিনে নদীটা দেখে নদীর ইতিহাস জেনে গেলে তাদের অজ্ঞতা বিলীন হতো।

কালাঘোষা নদী বা কালাগাঙ: কালাঘোষা নদী একটি অতিশীর্ণ নদী, তাই এটিকে নদী না বলে আঞ্চলিকভাবে কোথাও কোথাও কালাঘোষা ঝোরা বা ঝরনা নামেও ডাকা হয়। তবে বর্ষাকালে পানির প্রবাহ এবং স্রোতের প্রাবল্যে এই নদী, নদীর রূপ ধারণ করে খরস্রোতা হয়ে ওঠে। তখন এ নদী, নদী নামে সার্থক হয়ে প্রতিভাত হয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এ নদীর কোন নম্বরে চিহ্নত করেনি। কালাঘোষা নদী একটি আন্তর্জাতিক নদী। এটি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে ঝিনাইগাতী উপজেলার হালচাটিগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরে নদীটি দক্ষিণমুখি হয়ে কাংশা ইউনিয়নের হালচাটি জোকাকুড়া, গোবরাকুড়া ধানশাইল ইউনিয়নের ধানশাইল গ্রাম,ও চাপাঝোরা দাড়িয়ার পাড়ের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দাড়িয়ার পাড়ের দক্ষিণে পূর্বমুখি সোমেশ্বরী নদীতে পতিত হয়েছে। তবে বর্ষাকাল ব্যতিত অন্য কোন সময় এ নদীর কোন অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। তবে নদীটি যখন খরস্রোতা হয় তখন এ নদী দিয়েও বৃক্ষ বা অন্যান্য জিনিস ভেসে আসে। ১৯৭১ সালে ঝিনাইগাতীর নকশীতে পাকবাহিনীর সাথে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এই নদী দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যোগাযোগ করতো। বর্তমানে কালোঘোষো নদী প্রায়ই তার অস্তিত্ব হারাচ্ছে এবং মানুষের মুখের আলোচনা থেকে সরে যাচ্ছে।

পাগলা নদী : পাগলা নদী একটি আঞ্চলিক নদী এবং এটি অন্য কোন নদীর উপনদী বা শাখানদীও নয়, বরং এটি সোমেশ্বরী নদীর একটি অংশমাত্র। সোমেশ্বরী নদী ভারতের মেঘালয় থেকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে শ্রীবরদির ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে দক্ষিণপূর্বমুখি হয়ে ঝিনাইগাতী উপজেলায় প্রবেশ করে। পরে এটি দক্ষিণমুখি হয়ে কাংশা ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে ধানশাইল ইউনিয়ন অতিক্রম করার সময় উক্ত দুই ইউনিয়নের পানবর,দুপুরিয়া, বিলাসপুর ও বাগের ভিটা গজারমারী বিল, ধলী বিল এলাকায় বর্ষা মৌসুমে প্রবল স্রোতে নদীর গতিপথ বছরেই দুই তিনবার বদলে ফেলে এবং ওইসব এলাকায় নদীটি একটি সাগরের মত রূপ ধারণ করে। এ সময় এ নদীর তাণ্ডবে উল্লিখিত গ্রামগুলোর মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ বেড়ে যায়। তবে এ দুর্ভোগ কাটিয়ে ওঠে মানুষজন যখন পরবর্তী বর্ষার জন্য আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখে তখন পাগলা নদীর গতিপথ এমন এক দিক দিয়ে প্রবাহিত হতো যে, মানুষ আগে থেকে অনুমানই করতে পারে না। সোমেশ্বরী নদী এলাকার ওই কয়টি গ্রামে এমন গতিপথ পরিবর্তনের জন্য ওই এলাকায় সোমেশ্বরী নদীর নাম হয় পাগলা নদী। এও মনে রাখতে হবে যে পাগলা নদীর এমন প্রাবল্যে সোমেশ্বরী নামই প্রায় হারিয়ে যেত। অথচ এটা আলাদা কোন নদী নয় আদৌও। আর এ জন্যই নেত্রকোণা জেলার লোকেরা শেরপুর জেলায় কোন সোমেশ্বরী নদী খুঁজতে এসে হয়তো পাগলা নদীর পাগলামীতে আর খুঁজেই পাননি আজও পর্যন্ত। আমরা চাই এই ভুল তথ্যের বৈজ্ঞানিক সমাধান। তা যাইহোক পাগলা নদীতে মাছের কোন কার্পণ্য এক সময়ে ছিল না। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এ নদীকে পুরোটাই সোমেশ্বরী হিসেবে দেখিয়েছন তাই এ নদী কোন নম্বর দ্বারা চিহ্নিত করেনি।

মালিঝি নদী : পাগলা নদীর মত মালিঝি নদীও একটি আঞ্চলিক নদী হলেও এটি ঝিনাইগাতী উপজেলার একটি গুরুত্ব পূর্ণ নদী। মালিঝি নদীর উৎপত্তি ঝিনাইগাতী উপজেলার বগাডুবি ব্রীজের পুবে চতল নামক স্থানে মহারশি নদী ও সোমেশ্বরী নদীর মিলিত স্রোতধারা থেকে। উৎপত্তিস্থল থেকে ব্রহ্মপুত্র নদীতে পতিত হওয়া পর্যন্ত এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৬ কি. মি. এবং প্রস্থ ৫২ মিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রদত্ত নদী নম্বর ৭০। যদিও ঝিনাইগাতী উপজেলায় এ নদীর দৈর্ঘ্য ১৩/১৪ কি. মি. এর মত তবুও এনদীকে ঘিরেই বাংলাদেশের দক্ষিণ দিক থেকে উত্তরে নদীপথে ঝিনাইগাতী,শ্রীবরদি এবং নালিতাবাড়ি, নন্নী ও বারোয়ামারী মিশন ও মরিয়ম নগর মিশন ও শ্রীবরদি থেকে ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ি পর্যন্ত সকল সীমান্ত ফাঁড়ির লোকজন ও মালামাল যাতায়াত করতো। এ নদী পথে শেরপুর ও জামালপুর এর লোকজন কাটাখালি ব্রীজ থেকে ডাকুরি নদী হয়ে পূবদিকে মালিঝি নদী ও নানা খাল বিল অতিক্রম করে নালিতাবাড়ি এবং পশ্চিম দিকে মালিঝি নদী হয়ে ডাকুরি নদী দিয়ে লোকজন গড়জরিপা সংলগ্ন কালিদহ সাগর ( স্থানীয় নাম) হয়ে শ্রীবরদি পর্যন্ত যাতায়াত করতো। আবার মালিঝি নদীর ধারা অতিক্রম করে মহারশি নদীপথে ঝিনাইগাতী ব্যবসাকেন্দ্র এবং ঝিনাইগাতীতে অবস্থিত সীমান্ত ফাঁড়িগুলিতে যাতায়াত করা যেত এবং সোমেশ্বরী ( পাগলা সহ) নদীপথে শ্রীবরদির ভায়াডাঙা,বালিজুরি হয়ে ধানুয়া কামালপর দিয়ে বকশিগঞ্জেও যাতায়াত করা যেত। এজন্য ঝিনাইগাতীতে মালিঝি নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া ঝিনাইগাতীর অন্যান্য নদীর তুলনায় এ নদী মৎস সম্পদে ভরপুর ছিল এবং ঝিনাইগাতীর একমাত্র নদী হিসেবে এই নদীর পানিতে বোরো ধানের আবাদ হতো। এখন অবশ্য সব নদীর পানিতেই সেচকার্য চলে। তবে মালিঝি নদীর ভূমিকা ঝিনাইগাতীর হাতিবান্ধা ও মালিঝিকান্দা ইউনিয়নে অনন্য। জানা য়ায় এ নদীর নামেই ” মালিঝি নদীর তীরে/ মালিঝির বাঁকে ” একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে।

ডাকুরি নদী: ডাকুরী নদী একটি আঞ্চলিক নদী। এ নদীর দৈর্ঘ্য ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার তবু দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এ নদীপথেই হয়েছিল বলে এ নদীর নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে সোনালী আখরে। এটি একটি সর্পিলাকার নদী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এ নদীকে হিসাব করেনি, তাই এটাকে কোন নম্বর দ্বারা চিহ্নিত করেনি। ডাকুরি নদীটি ঝিনাইগাতীর মালিঝি নদীর স্রোতধারায় থেকে বেরিয়ে এসে পশ্চিম দিকে টাকিমারি বিল হয়ে রাঙা- মাটি, বাতিয়াগাঁও ও হাসলিগাঁও এর দক্ষিণ কিনারা দিয়ে জুলগাঁও, বানিয়াপাড়া ও চেঙ্গুরিয়া হয়ে ছয়টি গ্রাম স্পর্শ করে শ্রীবরদি উপজেলার গড়জরিপা গ্রামের পাশে কালিদহ সাগরে পতিত হয়েছে। এই স্বল্পদৈর্ঘ্য নদী লম্বায় অনেক বড় না হলেও এই নদীপথে শেরপুর- জামালপুর থেকে কাটাখালি ব্রীজের নিকট থেকে পূর্বদিকে নালিতাবাড়ি যাওয়া স্থল পথের চেয়ে ( হাঁটাপথ) সহজ ছিল। এবং এই নদীপথে পশ্চিম দিকে গড়জরিপা ইন্দিলপুর হয়ে শ্রীবরদিও যাতায়াত করা যেত। যদি কালিদহ সাগরের চাঁদ সওদাগরের মধুডিঙ্গা সত্য হয়ে থাকে তাহলে সেই মধুডিঙ্গা এই নদীপথ হয়েই মালিঝি নদীপথে বৃহৎ নদী ব্রহ্মপুত্রে সওয়ার হতো বলে আমরা অনুমান করি। কারণ কালিদহ সাগর ছিল তৎকালীন কামরূপ রাজ্যের রাজধানী এবং পরে শেরপুর রাজ্যের রাজধানী গড়জরিপা সংলগ্ন এবং সাগর থেকে বেরোবার আর কোন জলপথ ছিল না। এবংবিধ যাতায়াতের জন্য ডাকুরি নদী বিখ্যাত। অন্য যে কারণে ডাকুরী নদী বিখ্যাত তার মধ্যে একটি হলো ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ নং সেক্টরের ১নং কোম্পানী কমান্ডার স্বাধীনতা পুরস্কর (মরোনোত্তর) প্রাপ্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল আহসানের কাটাখালি ব্রীজ অপারেশন করে তা গুড়িয়ে দেওয়া। আর কাটাখালি ব্রীজটি তারও আগে থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই ডাকুরি নদীর ওপরেই দণ্ডায়মান। এমনকি এই কাটাখালি বীজের সফল অপারেশন শেষে নাজমুল আহসান ও তার দল যে বিল সাঁতরে রাঙামাটি গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন সে বিলের নাম ভেরভেরি বিল যা জুলগাঁওয়ের দক্ষিণ দিকে এবং বানিয়াপাড়া ও চেঙ্গুরিয়া গ্রামের উত্তর দিকে অবস্থিত এবং এই বিলের মাঝখান দিয়ে পূর্বদিক থেকে প্রবাহিত ডাকুরি নদী যা ওই তিনটি গ্রামের সীমানা নির্ধারকও বটে। শহীদ নাজমুল আহসান এর দল মূলত এই ডাকুরি নদীকে নিশানা ধরে পূর্বদিকে রাঙামাটি গ্রামে যাচ্ছিল আত্মগোপন করে থাকার জন্য। এই জন্য ডাকুরি নদী এতদঅঞ্চলের মানুষের কাছে প্রিয় এবং ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে এই ডাকুরি নদীর নাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে কাটাখালি ব্রীজ থেকে পশ্চিম দিকে এই নদী এখনও চেনা গেলেও ব্রীজের পূর্ব দিকে এই নদী কোয়ার্টার কিলোমিটার পর থেকে বিলের সাথে মিশে একাকার হয়েছে, তাকে আর আলাদাভাবে সনাক্ত করা যায় না। তাই আমাদের দাবি, ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে হলেও এই নদীটি খনন একান্ত দরকার এবং আমরা এই দরকারের আশু বাস্তবায়ন চাই।

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *