এইসব দিনরাত্রির চিরকুট
এইসব দিনরাত্রির চিরকুট
পারভেজ শিশির
কন্ঠ ১:
দেখার মতো চোখ থাকলে,
কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখও দেখা চলে,
তোমাকেও কি আমি সেভাবেই দেখেছিলাম?
নাকি শুধু অনুভবের অন্তর্জালে আঁকড়ে ধরেছিলাম—
সুরভি সেই শ্যামল চোখের গভীরতায়?
উদ্বেল অনুভূতি থাকলে,
সবুজ ঘাস ছুঁয়েও তাকে স্পর্শের আনন্দলাভ হয়,
তুমি কি কখনো ঘাসের শিহরণে ছুঁয়েছিলে,
তোমার প্রাণ প্রিয়তম’কে?
নাকি শুধু হাওয়ায় ছড়ানো সুবাসে
অনাদিকালের না-দেখা সুর বাজিয়েছিলে?
কন্ঠ ২:
আমি দেখিনি, শুধু অনুভব করেছি,
কালো মেয়ের হরিণ চোখে দিগন্তের নীলিমা,
সবুজ ঘাসের মধ্যে এক অদেখা অনুরণন,
প্রতিটি ছোঁয়ায় মনে হয়েছিল—
সে এই এলো, আমার প্রিয়তম যেন ধরা দিল,
স্পর্শের মাঝেও অনির্বচনীয়…
তোমার স্পর্শ অনুভব করেছিলাম,
যদিও তা ছিল ক্লান্তির সুদূরে,
কীভাবে সেই স্পর্শকাতর দিগন্ত আমায় ডেকেছে,
তুমি তো আমাকে ছোঁওনি, তবু স্পর্শ পেয়েছিলাম…
কন্ঠ ১:
হৃদয়ে স্থান পায় বলেই,
দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা জীবন্ত হয়ে নিঃশ্বাস ফেলে,
মাইকেলেঞ্জেলোর পিঁয়েতা চোখের জলে কথা বলে—
তুমি কি পেয়েছো সেই নিঃশ্বাসের স্বরলিপি?
সেইসব অশ্রুজলের শব্দচিত্র…!
নাকি শুধু হৃদয়ের শ্বাসরুদ্ধকর মূর্ছনায়
তাদের স্পর্শ পেতে চেয়েছো?
গোলাপ পাঁপড়ি চাপা পড়া ডায়েরির মাঝে
কখনও কি খুঁজে পেয়েছ সেই হারানো ছন্দিত সুর?
কন্ঠ ২:
হ্যাঁ, আমি খুব অনুভব করেছি,
মোনালিসার মৃদু হাসির রহস্য;
তাতে লুকিয়ে ছিল অব্যক্ত দীর্ঘশ্বাসের বর্ণমালা,
পিঁয়েতার পাথরের গায়ে ছিল অনন্ত ব্যথার প্রলেপ
অথচ হৃদয়ের গভীরে তা ছিল জীবন্ত,
জীবনের মতোই জলজ—
তুমি কি জানো, সেই ডায়েরির প্রতিটি পত্রকাব্য
আমার স্মৃতিতে আজও জেগে রয়েছে…!
গোলাপের সুবাসের মতোই মিষ্টি,
তুমি কি কখনও সেসব আবৃত্তি করেছো আনমনে?
কন্ঠ ১:
আমি হয়তো সেই যন্ত্রণাগ্রস্থ কাব্যের ঢেউ ভুলে গেছি,
কিন্তু তার প্রতিটি শব্দে এখনও একই শিরশিরানি জাগে,
হৃদয়ের প্রতিটি কণায় ছড়িয়ে পড়ে
এক অজানা শতপাখা স্যিম্ফোনি
যা রোধ করা যায় না, শুধু বাকরুদ্ধ হতে হয়—
যেমন রোধ করা যায় না প্রথম প্রেমের আনন্দ অশ্রু
জন্মান্ধ কিভাবে জানবে,
প্রিয়তমের গালের তিল কত সুন্দর ! —
তুমি কি তা আঁকতে পেরেছ কোনো নির্বাক ক্যানভাসে?
কন্ঠ ২:
আমি দেখিনি, আজও দেখা হয়নি, তবু জানি,
প্রিয়তমের গালের তিল ঠিক কতটা নিরুপম…
মনে হয় যেন আমার প্রতিটি ছোঁয়ায় সে প্রকাশিত
তুমি দেখো, আর আমি অনুভব করি,
এক রতি তিলে লুকিয়ে থাকা সীমাহীন আকাশ—
আমাদের দুটি মন একসাথে
সেই নিঃসীম সৌন্দর্যে ডুব দিয়েছে…
তুমি কি দেখেছ সেই জলের উপর
কীভাবে ভেসে ছিল আমাদের প্রাণের পরাগরেঁনু…
কন্ঠ ১:
যে সব রেঁনু একদিন হাওয়ায় উড়েছিল,
প্রাণে প্রাণে লিখিত অদৃশ্য চিরকুট হয়ে,
অথচ আমরা সে সব ছুঁয়ে দেখিনি
প্রভাত ভৈরবের মত,
আমাদের প্রাণে এসে তরঙ্গিত হয়েছে কেবল—
জন্মান্ধের মতো আমরাও একে অপরকে,
হৃদয়ের এসরাজে চিরতরে বেঁধে ফেলেছি…
আর আমাদের হারানোর কিছু নেই,
নিজেদের মধ্যেই আমরা আমৃত্যু হারিয়ে গিয়েছি…