অক্টোবর ২৭, ২০২৪

ইটের ঢিল

তাহমিনা নিশা

আমি তখন কুষ্টিয়ার একটি গ্রামের বাজুমারা, জোতাশাহী স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলাম।আমি বিবাহিত। দু’টি ফুটফুটে কন্যা সন্তান, মায়া ও শিল্পীর সাহসী পিতা। সাহসী বলছি এই জন্যে যে, স্কুলের সকলেই আমাকে বেশ সম্মান করে,ছাত্ররা ভয় পায়, গ্রামের সবাই মান্য করে। আর কন্যা সন্তানের পিতাকে একটু সাহসী না হলে চলে না। তো, আমি যথেষ্ট মনোযোগ ও নিষ্ঠার সাথে নিজের স্কুলের দায়িত্ব পালন করে আসছি। আর সরকারী অফিসার পদে চাকুরীর আশায় পত্রিকায় চোখ রাখছি। সে কারণে বিভিন্ন দপ্তরে দরখাস্ত লিখে যাচ্ছি। যেহেতু কন্যার মা চায়, গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে থাকতে। আর আমিও ভেবে দেখলাম, সন্তানদের উন্নত জীবনের জন্যে আমাদের শহরে যেতেই হবে।

অবশেষে একদিন পিডিবির একাউনটেন্ট পদে আমার সরকারী চাকুরী হয়ে গেল। পোষ্টিং হলো “ঘোড়াশাল” নামক একটা শহরে।আমি ঘোড়াশালে গিয়ে প্রথমে মেসে উঠলাম। সরকারী কোয়ার্টারের জন্যে এপ্লিকেশন করলাম।কিছুদিনের ভিতরে আমার নামে সরকারী কোয়ার্টারও পেলাম। হাতের কাজ গুছিয়ে নিয়ে মায়া, শিল্পী ও তাদের মাকে আনবার জন্যে বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় আমাদের দেশের অবস্থা উত্তাল হলো। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। আমি প্রাণ ভয়ে স্ত্রী সন্তানকে দেখবার আশায় ঘোড়াশাল ছাড়লাম।দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ শেষে আবার এসে ঘোড়াশাল অফিসে জয়েন করলাম। এবারও আমি একাই এসেছি। যুদ্ধ পরবর্তী দেশে লুট পাট যত্রতত্র হয়েই যাচ্ছে । তাই পরিবেশ পরিস্থিতি শান্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা আর কি।

যখন সুবিধা মনে করলাম, স্ত্রী ও সন্তানদের কোয়ার্টারে নিয়ে আসলাম।আর মায়া শিল্পীর মাকে সাহায্য করার জন্যে ফরিদা(ছদ্মনাম) বলে একটি তেরো চৌদ্দ বছরের মেয়েকেও সাথে আনলাম।মেয়েটির রঙটা চাপা তবে কাজল পরা চোখ। ঘন কালো ঢেউ খেলানো লম্বা চুল। সংসারের সব কাজ খুবই গুছিয়ে পরিপাটি করে করতে পারে।প্রায় পাঁচ ছয় মাস লেগেই গেল সংসারের আসবাবপত্র কেনাকাটা করে ঘর সাজাতে। মায়া- শিল্পীকে স্কুলে ভর্তী করিয়ে যখন একটা স্থিতিশীল অবস্থা। আমরা নতুন শহরে নিশ্চিন্তে জীবনযাপন শুরু করবো এমনই চিন্তা ভাবনা করছি। কিন্তু হঠাৎ একদিন দুপুরে আমাদের ছাদের উপরে একটা ঢিল এসে পড়ল। এখানে বলে রাখি , সরকারী বাসাগুলোর ফ্লোর ও ওয়াল পাকা, আর ছাদটা টিনের ছিল। মোটকথা টিনের ছাদওয়ালা পাকাবাড়ি। তো টিনের চালে ঢিল পড়লে শব্দ তো হয়ই। প্রথমবার পড়াতে তেমন কানে লাগালাম না। ভাবলাম, ছেলেপুলে কেউ হয়তো খেলতে গিয়ে ঢিল ছুঁড়েছে । পনেরো মিনিট পরে আবার একটা ঢিল।এবার ঘরের মধ্যে থেকে আওয়াজ দিলাম,

— এই, কে রে?

দেখি, সব চুপ। ভাবলাম ভয় পেয়েছে। আর মারবে না। কিন্তু এবার দশ মিনিট পরে আবার যখন ঢিল পড়ল। তখন আর ঘরের মধ্যে না থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। মুখে গজগজ করতে করতে বলতে লাগলাম,

— দাঁড়া ! পাই একবার! কত ধানে কত চাল বুঝিয়ে দেবো!

বাড়িটার চারপাশে ঘুরে দেখে নিলাম। কই? আশেপাশে সন্দেহ জনক কেউ নেই তো! আসলে এই ভর দুপুরে ছুটির দিনে সবাই বিশ্রাম নেয়। বাইরে তাই মানুষ ই কম। কাটফাটা রোদ থেকে ঘরের ভিতরে এসে কেবলই এক গ্লাস পানি মুখে দিতে যাবো ওমনি আবার একটা ঢিল।এইভাবে এক মিনিট পরপর পড়ছে। আস্তে আস্তে ত্রিশ সেকেন্ডে চলে এলো। মায়া- শিল্পী আতঙ্কে জড়াজড়ি করে বসে আছে। ওদের মা, জানালা বন্ধ করার চেষ্টা করছে। যেন ঐ ঢিল ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়তে না পারে। আমি যে বাইরে বের হবো, তারও উপায় নেই। শব্দ শুনে বুঝতে পারছি, বেশ বড় সাইজের একেকটা ঢিল হবে। বাইরে গেলে যদি মাথায় পড়ে তাহলে পটল তুলতে হবে। দুপুরের রোদটা কমে গেলে আছরের আজান দিলে ঢিল পড়া আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। ভয়ে ক্লান্ত হয়ে আল্লাহের নাম নিতে নিতে মায়া ,শিল্পী, ফরিদা ঘুমিয়ে পড়েছে। মনে হলো সেই যাত্রায় বাঁচলাম। বিকেলে বাইরে বেড়িয়ে দেখি,কোনো ঢিল নাই।

অথচ হিসেব মতে, ঢিলগুলো চাল বেয়ে গড়িয়ে তো নীচে পড়ার কথা। কিন্তু বাড়ির বাইরে ও আশেপাশে পুরোই ফাঁকা।এটা দেখে একটু তো মনটা নাড়া দিয়ে উঠল! সে আমি যতই সাহসী হই না কেন।পাশের বাড়ির মানুষদের আচরণ দেখেও বুঝতে পারলাম, তারা কেউ কিছুই জানে না। মনের ভুল হলে তো আমার একার হতো। আমার পরিবারের বাকি চার সদস্যদের নিশ্চয়ই হতো না। তবে এটা কি ছিল?

রাতভর এই একই চিন্তায় ঘুম তেমন একটা আসলো না।তারপরেও তৈরী হয়ে অফিসে গেলাম। মনের মধ্যে একটা টেনশন কাজ করছে, না জানি আজকে কি হয়? ভয়ে ভয়ে অফিস থেকে দুপুরে বাসায় লাঞ্চ করতে এসেছি।নাহ্ ! গতকাল যেই সময় ঢিল পড়েছিল আজ সেই সময় পার হয়ে গিয়েছে। তারমানে বিষয়টা মিটে গিয়েছে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লাঞ্চ শেষ করে আবার অফিসে চলে গেলাম। সেই দিন আর কিছুই হলো না। সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ শেষে মসজিদের ইমামকে গতকালকের ঐ ঘটনা খুলে বললাম। বললাম,

— এই ঘটনায় আমার বাচ্চারা ভীষণ ভয় পেয়েছে।

ইমাম সাহেব বললেন,

—কোনো দুষ্টু জ্বীনের কাজ হবে, আপনাদের ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু এর আগে তো এই এলাকায় ঢিল ছুঁড়া কোনো জ্বীন ভূতের কথা শুনি নাই।যাক্ আমি একগ্লাস পানিতে দোয়া পড়ে দিচ্ছি। আপনি, আপনার স্ত্রী ও বাচ্চাদের পান করিয়ে দিয়েন। ভয় কেটে যাবে।ইনশাআল্লাহ

আমি দোয়া পড়া পানিটা এনে সবাইকে খাইয়ে দিলাম। ফরিদাকে যখন পানি দিতে যাবো, তখন আমার হাত থেকে ফসকে গ্লাসটা পড়ে গিয়ে পানিটুকু মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে।ফরিদার আর সেই পানি পান করা হয় না, ব্যস্ ঐ পর্যন্তই। আমরা কিছুদিন ভয়ে ভয়ে থেকে পরে যখন আর ঢিল পড়ছে না, বা সেই ধরনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না, তখন স্বাভাবিক ভাবেই জীবনযাপনে আবারও অভ্যস্ত হয়ে যাই।

প্রায় বছর খানিক পরে এক ছুটির দিনে বাজার থেকে অনেক প্রকার মাছ কিনে এনেছি। আমার স্ত্রী ও মেয়েরা মিলে সেই মাছ কাটা ধুয়াতে ব্যস্ত। এমন সময় আবারও ঢিল পড়া শুরু হলো।এবার আর একটা দুটো ঢিল নয়, যেন ঢিলা বৃষ্টি হচ্ছে। রান্না বান্না বাদ দিয়ে মায়া, শিল্পী ও তাদের মা সাথে আমি শোয়ার ঘরে এসে গুটিশুটি মেরে খাটের উপরে বসে আছি।কতখন পরে লক্ষ্য করি, আমরা সবাই এখানে, ফরিদা কোথায়? এটা মনে হতেই আমার স্ত্রী জোরে জোরে ডাকতে লাগলো,

— ফরি, ফরি… ও ফরিদা….? কিরে? এদিকে আয়! একা একা রান্না ঘরে কি করিস? এদিকে আয়। রান্না বাদ দে! আয় এখানে!

কিন্তু কে শোনে কার কথা? এত ঢিলের শব্দ যে, রান্নাঘর পর্যন্ত আমার স্ত্রীর আওয়াজ যাচ্ছেই না।আমরা কেউ যে গিয়ে ফরিদাকে আমাদের কাছে এখানে ডেকে নিয়ে আসবো, এই মূহূর্তে সেই সাহসটাও নেই। এদিকে ফরিদা নিজের মনে সব গুছিয়ে রান্না বান্না চুলায় চাপিয়ে বেশ আছে।সে এক এক করে রান্না খাবার এনে টেবিল সাজাচ্ছে। আমরা সবাই সেটা দেখে আশ্চর্য হচ্ছি! এটা কি করে সম্ভব? ওর কি ভয় করছে না? আমরা সবই ভয় কাটানোর জন্যে দোয়া পড়া পানি খেলাম, কিন্তু ফরিদা তো খায়নি। তাহলে ওর এত সাহস এলো কোথা থেকে? এসব নিয়ে যখন আমরা চারজন আলোচনা করছি, এমন সময় মসজিদে আজান দিলেই ঢিল পড়া বন্ধ হলো। আমি ও আমরা বাইরে গিয়ে তখনও কোনো ঢিলের আলামত দেখতে পেলাম না। তবে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এই বাড়িতে আর নয়। এই বাসা আমরা পরিবর্তন করবো।

ফরিদাকে জিজ্ঞাসা করা হলো,

— কিরে তোর তো সাহস মন্দ না? এই ঢিলের শব্দেও তুই দিব্যি রান্না করে ফেললি?

সে জবাব দিল,

— ভয় করে কি করবো? খিদা তো আর ভয়ে যাবে না। ভাত তো খাওয়া লাগবেই, তাই না? আর ঐ ঢিল তো আমার গায়ে পড়ছে না। কাজ না করে হাত গুটিয়ে বসে থেকে লাভ কি? তাই রান্না করেছি।

আমি মনে মনে ভাবলাম, এতটুকু মেয়ের কত সাহস! অথচ আমি নিজেকে কত সাহসী বলে জাহির করতাম! যায় হোক, আমি বাড়ীটি পরিবর্তন করবো। কিন্তু কোথায় বাড়ি নেয়া যায় তা ভাবছি। এমন সময় মনে হলো, যুদ্ধের আগে পরে মিলিয়ে আমার তো এখানে চাকুরীর বয়স তিন বছর পুরণ হয়েছে। আমি এখন ষ্টেশন পরিবর্তনের দরখাস্ত করতেই পারি। ঘোড়াশাল থেকে কুষ্টিয়ার কাছাকাছি যাওয়া যায় কিনা তার চেষ্টা করি। যেই ভাবা সেই কাজ। আমি উধ্বর্তন কর্মকর্তাকে এড্রেস করে দরখাস্ত করলাম। আর অপেক্ষা করতে লাগলাম জবাবের জন্যে। এরই মাঝে একদিন আমার পরিবারকে কুষ্টিয়ার বাজুমারা গ্রামে রেখে এলাম। আর আমি আমার সরকারী কোয়ার্টারটা তালা দিয়ে সেই পুরাতন মেসে উঠে গেলাম। এইভাবে ভয়ে ও আতঙ্কে দিন কাটানো যায় না। ভূতুড়ে বাড়ি থেকে রেহাই পেতে মনটা ব্যকুল হয়ে আছে। এদিকে মায়া শিল্পীর লেখা পড়ার ক্ষতি হচ্ছে। বেশ কয়েকদিন পরে আমার ট্রান্সফার লেটার হাতে পেলাম।খুলনাতে পোষ্টিং হয়েছে আমার। তবে সরকারী কোয়ার্টার পাওয়া যাবে না। আপাতত ভাড়ার বাসায় উঠতে হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম।খুলনায় আমার আত্মীয় থাকে। তাদের বলে দিলাম, আমার জন্যে একটা ভাড়ার বাসা খুঁজে রাখতে। আমি চারটা লেবার নিয়ে মালপত্র গুছিয়ে ট্রাকে তুললাম।

ব্যস্ ভূতের বাড়ি তো বিদায় হলো! আমার জীবনের বাজে একটা অভিজ্ঞতার হাত থেকে বাঁচলাম।এমনটাই ভাবছিলাম আমি। কিন্তু বিধাতা বুঝি আমার কপালে আরো বড় কোনো সারপ্রাইজ রেখেছেন! সেইদিন ঐ মূহূর্ততে তা আঁচ করতে পারিনি। বাড়ি থেকে মায়া শিল্পীরা তাদের মামার সাথে খুলনাতে চলে আসলো। দেরি না করে আমার দুই কন্যাকে খুলনার মন্নুজান সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তী করিয়ে দিলাম।তাদের পড়াশুনোর ইতিমধ্যে অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।বেশ ভালোই চলছিল দিনগুলো। এবার নিশ্চিন্তে সংসার করা যাবে!

কিন্তু কিন্তু কিন্তু… আবারও সেই ঢিল ভূতের আগমন ঘটল। এখানেও টিনের ঘর। আর একই রকম সেই ভয়ঙ্কর কান ঝালাপালা করা ঢিলের শব্দ! আচ্ছা, বিপদে পড়লাম তো! এটা কোনো কথা? ঘোড়াশালের ভূত খুলনায় এলো কি করে? মাথায় কিছু কাজ করছে না! আমাদের সাথেই এমনটা কেন হচ্ছে? এই বিষয় আশেপাশের কাউকে বললে, তারা কেউ কেউ বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।নয়তো মুখটিপে হাসে। কেউ যেন বিশ্বাসই করতে চায় না। কারো কারো ভাব তো এমন, যেন আমি পাগলের প্রলাপ বকছি।এই এলাকার প্রতিবেশীরা যে যার কাজে ব্যস্ত। কাউকে নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।আমি ও আমার স্ত্রী সমস্যাটা নিয়ে চিন্তায় পড়লাম! আমার স্ত্রীর মনে পড়লো একটা কথা। সে আমাকে বলল,

—তুমি কি খেয়াল করেছো? তুমি যেদিন বাজার থেকে বেশি করে মাছ কিনে আনো সেইদিনই এই ঘটনা ঘটে।

আমি একটু চিন্তা করে সব মিলিয়ে দেখে বললাম,

— হ্যা তাই তো ! সেই দুই দিনও অনেক মাছ এনেছিলাম বাসায়।তবে এর সাথে তেমন কোনো সম্পর্ক আছে? আমার মনে হয় না। সবাইই তো মাছ কেনে, সবার বাসায় কি ঢিলা বৃষ্টি হয়?

— তবুও ভালো, ঢিলগুলো কারো গায়ে পড়ে না। কিন্তু এইভাবে আর কতদিন? একটা কিছু ব্যবস্থা করো।

ঢিলের হাত থেকে বাঁচার জন্যে আর অসহিষ্ণু প্রতিবেশীদের কারণে আমি আবারো নতুন একটা বাড়ির সন্ধান করলাম।এই বাড়িটা আমার অফিসের কাছে। বাড়িওয়ালা বেশ কামেল মানুষ(ধর্ম কর্ম করা ভালো মানুষ)।খুলনা খালিশপুরে গাছ গাছালি ভরা বাড়ি, বেশ সুন্দর। এখানেও সপ্তাহ খানেক ভালোই ছিলাম। তারপর থেকে শুরু হলো ইটের ঢিল পড়া। তবে এবার ব্যতীক্রম যেটা লক্ষ্য করলাম তা হচ্ছে, শুধু আমরাই ইটা বৃষ্টি টের পাচ্ছি না। আশেপাশের মানুষেরাও দেখছে সেই ইটের বৃষ্টি। সকলের চোখের সামনেই ঢিল এসে পড়ছে। কোথা থেকে পড়ছে? কেমন করে পড়ছে? তা বোঝা যাচ্ছে না। উপর থেকে বৃষ্টির বেগে ইট পড়ছে।

বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক ছেলে পুলেদের নারিকেল গাছের মাথায় চড়ালেন। নির্দেশ দিলেন,

— কোন দিক থেকে ইট মারছে, দ্যাখ্! আমার বাড়িতে ঢিল মারে! কার এতবড় স্পর্ধা?

কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে গাছে থেকেও ঢিলের আগমনের হদিস তারা করতে পারলো না।এদিকে এই বাড়িতে ভূতুড়ে ঢিল পড়ার খবর আশেপাশের এলাকায় হু হু করে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক মানুষ তা দেখতে এসেছে।সবার সামনে ঢিল পড়ছে। উঠানের এককোণে স্তুপ করে রাখা ইট আছে।বাড়ি তৈরী করার পরে বাড়তি যেই ইট ,তা জমিয়ে রাখা।সেখানে কিছু অর্ধেক ও আস্ত ইট ছিল। সেই ইটও এসে বৃষ্টির মতো পড়তে লাগলো। এলাকার ছেলেরা ইটের গায়ে চক দিয়ে নম্বর লিখে দিলো। আশ্চর্যের বিষয় সেই নম্বর দেয়া ইটও আবার এসে সবার সামনে পড়ছে।

বাসায় মধ্যে শোয়ার ঘরে দুটো খাট পাতা আছে। আগেকার দিনে ষ্টান্ড ওয়ালা খাটের প্রচলন ছিল বাড়িতে বাড়িতে।চারপাশের চারটা ষ্টেন্ডের সাথে মশারীর ফিতা লাগানো হতো। কেউ কেউ মশারী ঐ ষ্টান্ডের সাথেই রেখে দিতো।এই কথাগুলো বলার কারণ… এই রুমেও তেমনি দুইটি খাট পাতা আছে। এগুলোর স্টান্ডের সাথে মশারী লাগানো আছে। সেই ঘরে আমাদের খুলনা শহরে থাকা মহিলা আত্মীয়রা এসে বসেছে ।তারা সবাই স্বচোক্ষে দেখতে এসেছে ঘটনাটা। মহিলারা কথাবার্তা বলছে, এমন সময় ঝুলানো দুই মশারীর ফাঁকা অংশ দিয়ে একটা আধা ইট এসে ফ্লোরে পড়ে। সবাই আতকে উঠে! চিৎকার দেয়! কেউ কেউ ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে যায়। বারান্দা ও উঠানে থাকা পুরুষেরা জানতে পারে, ইট এখন ঘরের মধ্যেও এসে পড়ছে। জানালা দরজা সব বন্ধ। ইটাঢিল তবে আসছে কেমনে? প্রথমে আধা ইট পড়ে, তারপর আস্ত ইট আসে। টিনের চালে কোনোই ফাঁকা নেই, থাকার কথাও না। ঘরের মধ্যে ইট এসে পড়ছে দেখে মহিলা আত্মীয়রা সবাই ভয় পেয়ে যায়।সমূহ বিপদের ভয়ে মানুষজন আস্তে আস্তে আমার বাসা থেকে কমতে শুরু করে।

বাড়িওয়ালা আমাকে নিয়ে নিজ উদ্যোগেই মসজিদের ইমামকে ডাকলেন। তারপর বাড়ির উঠানে পুরুষ মানুষেরা সবাই মিলে কয়েকটি কাতার করে নামাজ পড়া হয়। আমরা পশ্চিম দিকে মুখ করেই নামাজ পড়ি। এই বাড়ির পশ্চিম দিকে রান্নাঘর। তাই সঙ্গত কারণেই রান্না ঘরের দিকে মুখ করে নামাজে দাঁড়িয়েছি সবাই। নামাজের মধ্যেই রান্নাঘর থেকে ঢিল এসে পড়ে আমাদের সেজদারত মাথার সামনে। ইমাম সাহেব বলেন,

— এটা আর কিছু নয়, জ্বীনের আলামত। আমার পরিচিত এক জ্বীন ছাড়ানো ওঝা আছে, তাকে ডেকে আনলেই বোঝা যাবে, আসল ঘটনা।

সময় নষ্ট না করে ওঝাকে ডেকে আনা হলো। ওঝা বাড়িওয়ালা, ইমাম, এলাকার কিছু গন্যমান্য মানুষ ও আমাদের বাসার সবাইকে নিয়ে একটা বৈঠক( ওঝারা একত্রে বসে জ্বীন/আত্মা ছাড়ানোর প্রক্রিয়াকে বৈঠক বলে) বসান। তিনি তার সামনে আমাদের বসতে বললেন। আমরা সবাই এক এক করে ওঝার সামনে বসেছি। তিনি কি সব বিড়বিড় করে বলছেন আর আগুনে শুকনো মরিচ পুড়িয়ে তাতে সর্ষে দানা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছেন।! শুকনো মরিচ পুড়ছে… ধোয়া উঠছে… আমরা সবাই কাশছি। আমরা যারা যারা কাশাকাশি করছি, চোখে পানি চলে আসছে, তাদেরকে সেখান থেকে উঠে একটু পাশে সরে যেতে বলছে, ওঝা। আমরা একে একে সরে যাই। এখন ফরিদার পালা। প্রথমে তো সে এখানে বসতেই চাচ্ছিল না। পরে আমার দুই মেয়ে মায়া ও শিল্পী অনেক বলে কয়ে তাকে উঠানে নিয়ে আসে। উঠান থেকে ফরিদাকে আর ওঝার সামনে বসানো যায় না। তখন ওঝার হুকুমে আমি ও আমার স্ত্রী দুজনে মিলে খানিকটা জোর করে ফরিদাকে বৈঠকে বসতে বাধ্য করি।ফরিদার গায়ে যেন বিশাল শক্তি! আমি ও আমার স্ত্রী কিছুতেই তাকে ধরে রাখতে পারছি না। এক ঝাটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয়।আর কেমন যেন গোঙ্গাতে থাকে। দাঁত টিকিমিট করতে থাকে। ফরিদার মতো মিষ্টি একটা মেয়ের এমন ভয়ঙ্কর রূপ দেখে আমি হতভম্ব হই! আহত হই! তখনই বুঝতে পারি এতটুকু মেয়ের উপর দিয়ে না জানি এতদিন কত ঝড় বয়ে গিয়েছে! তা আমরা কেউ আঁচ করতে পারি নাই! মনে মনে ভয় লাগছে, শুনেছি জ্বীন-ভূত ছাড়ানোর জন্যে ওঝারা আছড় ধরা ( যার উপরে জ্বীন/ আত্মা ভর করে) মানুষের উপরে অত্যাচার করে। পিটিয়ে পিটিয়ে জ্বীন ছাড়ায়। এমন হলে তো আমাদের সহ্য করা কঠিন হবে। আমরা যে ওইটুকু বাচ্চা মেয়েকে মায়া শিল্পীর মতোই স্নেহ করি। আমার স্ত্রীর দিকে লক্ষ্য করলাম, সে মমতা মেশানো চোখে আতঙ্কে কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে! আমাদের জন্যে ঐ মূহূর্ত টা বা এটা মেনে নেয়া আসলেই কঠিন ছিল।

ওঝার সাথে আসা একজন ছেলে ও বাড়িওয়ালা নিজেই ফরিদার হাত শক্ত করে ধরে রাখেন।ওঝা আমাদের মতো একই রকম ভাবে মরিচ পোড়ার ধোয়া দেন। কিন্তু কি আশ্চর্য! কোনো কাশি হচ্ছে না ফরিদার! চোখে নেই একফোটা জল! তীক্ষ্ন দৃষ্টি ভঙ্গী । ওর দিকে তাকালেই যে কারো বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠবে।

ফরিদার গোঙ্গানী আস্তে আস্তে তীব্রতর হচ্ছে। ।তার ঘাড় থেকে মাথা কোন অশরীরীর নিয়ন্ত্রনে ডান বাম করতে থাকে। মাথার খোঁপা খুলে ঢেউ খেলানো কালো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। মুখ দিয়ে কেমন লালা পড়তে থাকে। চোখগুলো যেন বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে।কারো চোখে চোখ রেখে নেই সে। কিন্তু সবাইকে যেন ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে দেখছে।গগন বিদারী চিৎকার করে ওঠে ফরিদা।সেই কণ্ঠ ফরিদার তো নয়! পুরুষালী কন্ঠ।মনে হয় যেন দুই তিনজন এক সাথে কথা বলছে। ওঝা জিজ্ঞাসা করে,

— এই তুই কে? বল্ ! তুই কে?

ফরিদা কর্কশ কণ্ঠে গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে বলে,

— আক্কাস, আমি আক্কাস।

—এখানে কেন এসেছিস?

— আমি আইতে চাই নাই ।ওই ছেমড়ি (মেয়ে) নিয়ে আইলো ক্যান?

— কবে ফরিদাকে ধরেছিস?

— ওর ১২ বছর বয়সে।

— ও তোর কি করেছে? কেন ওকে কষ্ট দিস?

— ও দুপুরে চুল খুইলা আমার ঘুমের সময় দোল খায় ক্যান?

— ওকে কষ্ট দিস ক্যান?

—কষ্ট দেই না।

—তুই কোথায় থাকিস?

— রাস্তার মোড়ের ভেন্না গাছে

—কি চাস ফরিদার কাছে?

— কিচ্ছু চাই না। গেরামে যামু ।আমারে গেরামে রাইখ্খা আয়।

— গ্রামে গেলে কি তুই ইটা মারা বন্ধ করবি?

— গেরামে ইটা কই পামু?

— ফরিদাকে ছেড়ে দে

— না।দিমু না গ্যারামে যামু।

— কেন এদের ক্ষতি করছিস?

— কোনো ক্ষতি করি নাই।

— ইট মারছিলি কেন?

— মারমু। আমারে নিয়াইলো ক্যান?

—ইট মারা বন্ধ কর

— বাড়ি যামু

— বাড়ি গেলে ফরিদাকে ছাড়বি তো?

— বাড়ি যামু… বাড়ি যামু … বা..ড়ি….

বলতে বলতে ফরিদা অজ্ঞান হয়ে যায়। ওকে ধরা ধরি করে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।তারপর ওঝা আমাকে বলে,

—- ফরিদাকে যত শীঘ্রই পারেন বাড়িতে দিয়ে আসুন। আর যদি ফরিদার কাছ থেকে জ্বীন ছাড়াতে চান তবে সেটাও করে দিতে পারবো।খরচাটা অনেক করতে হবে।ফরিদার উপরে মারধোর করে জ্বীন ছাড়ানো যাবে। সেইটা আলাদা প্রসেস।তখন ফরিদার গ্রামে আমাকে যেতে হবে। ওর বাবা মায়ের ও সেই ভেন্না গাছের কাছে গিয়ে আমাকে বৈঠক দিতে হবে।আমি ও আমার দুই শাগরেদ সহ আপনারাও যাবেন। কিছু মানতের জন্যেও খরচা আছে। যদি রাজি থাকেন, তো বলেন…

— না ঠিক আছে। ফরিদার বাবা মায়ের কাছে আগে পৌছে দেই, তারপর তারা যা সিদ্ধান্ত নেয়, তাই ই করবো।

আমি পরের দিন ভোরেই ফরিদাকে কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়িতে রেখে আসি।অনেক পরে শুনেছি ফরিদাদের বাড়িতে সেই জ্বীন কোনোদিনও কোনো সমস্যা করে নাই।গ্রামে সবার টিন, ছন অথবা মাটির বাড়ি। তাই ইটের ঢিলের কারবার নাই। ফরিদাকে গ্রাম ছাড়া করলেই এই সমস্যা আবার হতে পারে বলে, তার বাবা মা তাকে আর অন্য কোনো শহরের বাসায় কাজে পাঠায় নাই। আমাদের বাসায়ও আর কখনো ঢিল বৃষ্টি হয় নাই।এদিকে আমি খুলনাতে বাকি চার বছর শান্তি পূর্ণভাবে চাকুরী করে পরবর্তীতে নিজের শহর, কুষ্টিয়া সদরে পিডিবির অফিসে বদলী হয়ে চলে আসি।

এই ছিল আমার ফুফাতো ভাইয়ের বলা ঘটনা। যা তিনি আমার মাকে শুনিয়ে ছিলেন। মা এই শেষের দিনের ঘটনার সাক্ষী ছিল। ঘরের মধ্যে যেদিন ইট পড়েছিল, সেদিন মা সেই ঘরেই খাটের উপরে বসা ছিল। আর সেই রান্নাঘরের সামনের নামাজের সময় আমার বাবাও এক কাতারে নামাজ আদায় করেছিলেন।

অক্টোবর ২৭, ২০২৪

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *