আদুরিনী
আদুরিনী
তাহমিনা নিশা
আমার বাবা মায়ের বিয়ের প্রায় সতেরো বছর পর আমার জন্ম হয়। একজন রাজকুমারী যতটা আদরে মানুষ হয়, আমার আদর কোনো অংশে তার থেকে কম ছিল না। বাবা মা দুজনই চাকুরী করতেন।আর দশটা পরিবারের চেয়ে আমাদের সচ্ছলতা তাই একটু বেশীই ছিল। আমাকে মা দাদুর কাছে রেখে চাকুরীতে যেতেন।আমরা দাদাভাইয়ের পৈতৃক বাড়ীতেই থাকতাম।
আমি যখন স্কুলে ভর্তী হই, তখন থেকে মা তার চাকুরী ছেড়ে দিলেন। এতো কাঙ্খিত সন্তানের বড়ো হওয়া সে খুব কাছ থেকে দেখতে চায়। আমাকে মা ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়ে স্কুলের গেইটেই বসে থাকতেন। অথচ আমি ঢাকা শহরের একটি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যথেষ্ট নিরাপত্তার ভেতরে থেকেই পড়াশুনো করতাম। এভাবেই আমি ওলেভেল পাশ করে এ লেভেলে উঠলাম।
আমাদের ক্লাসেরই একজনকে আমার ভালো লাগতে শুরু করে। মায়ের চোখ এড়িয়ে আমি তার সাথে কথা বলি, মিশি।মিশি বলতে ক্লাসের ফাঁকেই যতটুকু পারা যায় আর কি।তার দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে,তার সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে সময় চলে যায় টেরও পাই না।খুব ইচ্ছে করে ওর হাতটা ধরে একদিনের জন্যে হলেও ঘুরতে যাবার। কিন্তু মা যে পাহারায় আছে কলেজ গেটের ওপারে। তাই ইচ্ছেটা মনে মনেই থেকে যায়।অবশেষে একদিন সেই ইচ্ছে পুরনের সময়ও এসে যায়। অবশ্য ততদিনে আমরা বুয়েটের ছাত্র ছাত্রী।
হুম, দুজনই যখন বুয়েটে পড়াশুনো করি,তখন মা আর আমার সাথে আসে না আমাকে পাহারা দিতে। তখন আমরা স্বাধীন পাখি, দুজনে ক্লাস করি,অফ টাইমে গল্প করি, ঘুরে বেড়াই, একসাথে খাই, রাত জেগে ক্লাস ওয়ার্ক প্রাকটিক্যাল করি। পড়াশুনোর এত্তো এত্তো চাপ।সবই ঠিক ছিল কিন্তু সমস্যা হলো যখন বাবা মা জানতে পারলো আমার পছন্দের মানুষটি অন্য ধর্মের সন্তান।
আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে উচ্চ শিক্ষার জন্যে বিদেশে গেলাম। ততদিনে বাবা মা একটু একটু করে আমাদের সম্পর্কটাকে মানতে শুরু করতে থাকে। আমরা সফলতার সাথে বিদেশ থেকে ডিগ্রী নিয়ে ফিরে আসলে আমাদের দুই বাড়ীর সকলের মন খারাপ থাকা সত্বেও সবার সম্মতিতেই আমাদের বিয়ে হয়। আত্মীয় স্বজন ছাড়াই বাবা মা ও আমাদের কিছু বন্ধুর উপস্হিতিতে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আমাদের বিয়ে হয়ে যায়।বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল ছাব্বিশ ও তার সাতাশ বছর।
যেহেতু বেশী বয়সে বিয়ে, তাই আমরা নিজেদের কেরিয়ার গঠন করেই সন্তানের চেষ্টা করতে লাগলাম। কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি- দুই বছর পার হয়ে গেল সন্তানের দেখা পেলাম না। এই ভাবে চার বছর – ছয় বছর – আট বছর চলে গেল। কত রকমের ডাক্তার, কবিরাজ, দেশী বিদেশী চিকিৎসক দেখানো-কিছুই বাদ রাখলাম না আমরা।সবাই বলা বলি শুরু করে দিল- ‘মায়ের মতো হয়েছে’। এই কথাতে আমি আর কতটুকুই বা কষ্ট পেতাম, তারচেয়ে দশ গুণ বেশী কষ্ট পেতো আমার মা।আমি মাঝে মধ্যে একা থাকলে ভাবতাম-‘কতো চেষ্টা সাধনার মাধ্যমে আমার জন্ম, কতো আদরে আমি মানুষ হয়েছি, বিনিময়ে বাবা মাকে শুধু কষ্টই দিয়ে যাচ্ছি। অন্য ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করে প্রথম কষ্ট দিলাম আর এখন সন্তান হচ্ছে না দেখে মাকেই খোঁচা দিচ্ছে সবাই।’ অবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম আমি টেস্টটিউব বেবী নেবো।
আমার একটা সুন্দর মিষ্টি পরীর মতো বেবী হলো। ওকে প্রথম নজর দেখেই আমার মনে হলো আমার মায়ের জন্ম হয়েছে আমার কোলে। কিন্তু হায়! দুঃখের রাতের যেন ভোর হতে চায় না! আমার বেবীটার পা দুটো উল্টো হয়েছে। মানে-হাঁটুর বাটি পেছনে,ফলে হাঁটুর নীচ থেকে পায়ের পাতা উল্টো দিকে হয়ে জন্মেছে বেবীটা।কি হবে এখন? কি করবো? কেন আমার সাথে এমন হলো? জ্ঞানত আমি কোনো পাপ করিনি,তাহলে এমন হলো কেন? হয়তো বাবা মাকে দুঃখ দেওয়ার জন্য তার শাস্তি স্বরুপ উপরওয়ালা আমার কোলে সন্তান দিয়েও প্রতিবন্ধী করে পাঠালেন।হাজার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন। বাবা মায়ের কাছে নিজের কৃতকর্মের জন্যে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করছি। উম্মাদিনীর মতো আচরণ করছিলাম আমি অতি আদরিনী হয়েও।
ডাক্তাররা অপারেশন করতে বলছেন। কিন্তু ভয়ও দেখাচ্ছেন। কেউ বলছেন এখনই অপারেশন করা ভালো হবে, কেউ বলছেন বড় হওয়ার পরে।ভীষন একটা দ্বন্দের মধ্যে পড়ে গেলাম আমরা। সমান তালে যার যার সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে যাচ্ছিলাম। কুসংস্কারপূর্ন মানত করতেও পিছপা হচ্ছিলাম না। সৃষ্টিকর্তার কাছে চাওয়া শুধু একটাই- ‘এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো।’
হয়তো কোনো কালে কোনো পূণ্য করেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা । তাই একজন জার্মানী থেরাপিস্টের সাথে আকর্ষীকভাবে দেখা হয়ে গেল আমাদের।তিনি বেবীকে ভালোমতো পরীক্ষা করে দেখলেন।তারপর বেবীর হাঁটু কিভাবে করে যেন বেঁধে দিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার মাত্র একমাসের মধ্যে বেবীর পা ঠিক হয়ে গেল! দেবদূতের মতো ডাক্তার যেন আমাদের জীবনে এসে আমাদের চিন্তার অবসান করে সুখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেলেন ।
তারপরের কাহিনী সেই আগের মতোই — আমি আমার মেয়েকে আমার মায়ের মতোই একই ভাবে আল্লাদে, স্নেহে, ভালোবাসায়, নিরাপদে, যত্নের সাথে মানুষ করে চলেছি।ছোট্ট সেই প্রাণটি হয়ে উঠেছে আমার আগ্রহের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু আমার আদুরিনী।