আগুন ফুলের মিছিল
আগুন ফুলের মিছিল
পারভেজ শিশির
কবি ও সাহিত্যিক আসাদ চৌধুরী-এর “বারবারা বিডলারকে” কবিতার নাট্যরূপ
চরিত্রসমূহ:
আসাদ – একজন অনুভূতিপ্রবণ সাধারণ মানুষের কবি— বাংলাদেশের মু’ক্তি’যু’দ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসা, যিনি পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষদের পক্ষ নিয়ে সংগ্রাম করতে চান। তার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির গভীরে রয়েছে দুঃখবোধ, ক্ষোভ, এবং মানবতার প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা।
বারবারা – একজন পশ্চিমা নারী, যিনি ভিয়েতনামের নির্যাতিত মানুষদের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ ক’রে একটি কবিতা লিখেছেন, কিন্তু তার জীবনে ব্যক্তিগত দ্বিধা ও সংগ্রামের কারণে অভ্যন্তরীণ ভাবে বিরোধপূর্ণ। আসাদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ, তার বোধ ও মানবিক অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে।
দৃশ্য ১: [মঞ্চের বিবরণ]
(মঞ্চে দুটি প্রাথমিক অংশ থাকবে—একটি যু’দ্ধ’বিধ্বস্ত মফস্বল শহর এবং অন্যটি ইউরোপীয় শহরের একটি ক্যাফে। মাঝে মাঝে আলোর সরন প্রতিসরনে দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরি করা হবে। মঞ্চের প্রান্তে টেবিলে মোমের আলোয়, পুরোনো চিঠির বাক্স এবং বইয়ের স্তূপ রাখা থাকবে। পটভূমিতে সুর ভেসে বেড়াবে, যেন প্রতিটি ইথারি সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে আছড়ে পড়া বেদনার ঝড় উঠেছে।)
আসাদ (চেয়ারে বসে, জানালার দিকে তাকিয়ে):
(স্বগতভাবে)
বারবারা, আমি তোমার লেখাটা বারবার পড়েছি।
ভি’য়েত’নামের মানুষগুলোর জন্য তোমার দীর্ঘদেহী ভালোবাসা…
পরার্থপরতার আত্মনিবেদিত উচ্ছ্বাসে যেন তোমার শব্দের ধাক্কায়
আমিও মি’ছি’লে নেমেছিলাম।
আমরা একে একে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম─
তোমার হৃদয়ের সুমঙ্গল বাতাস আমাদের নিয়ে গিয়েছিল মুক্তির পথে।
(একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে)
কিন্তু তুমি কি বুঝতে পেরেছ,
আমাদের এই প্রাচ্যের মানুষগুলোর আরেকটি যুদ্ধও চলছে,
একটা যু’দ্ধ, যে যু’দ্ধের মূল্য কেবল আমরা সাধারণ জনগণ দিচ্ছি─
আমাদের রক্ত, আমাদের ঘাম, আমাদের স্বপ্ন।
বারবারা (আসাদের দিকে তাকিয়ে, কিছুক্ষণ চুপ থেকে):
তোমার কথা শুনে আমার ভেতরে কিছু একটা বোধ জাগ্রত হচ্ছে, আসাদ।
কিন্তু আমি তখন হয়তো দূরে ছিলাম, ভি’য়ে’ত’নাম ছিল আমার কাছে পরিচিত, কাগজে কলমে,
তুমি যে বাংলাদেশের কথা বলছো─
আমি কীভাবে সেই অদেখা অশ্রুত সত্যটাকে উপলব্ধি করতে পারবো?
(কিছুক্ষণ চুপ)
তুমি বলো, আমার হৃদয় কি তোমার সেই ক্ষোভে কোনো সহজ্বলন নিশ্চিত করতে পারবে? আমি আর কোনো ভিয়ে’তনাম দেখতে চাইনে, আসাদ…!
আসাদ (বইয়ের তাকের দিকে তাকিয়ে):
বারবারা,
তোমার লেখাটা যখন পড়লাম, ভেবেছিলাম, তুমি বুঝতে পারবে,
তোমার কবিতা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়বে…
তুমি জানো, কেমন লাগে যখন সভ্যতার আকাশে রক্তিম সূর্যটা নিমিষে মুছে যায়।
কিন্তু তুমি হয়তো তখন সেই যুদ্ধের বর্বরতার ছবি, শাব্দিক ছবি আঁকলেও
আমাদের এ যুদ্ধ─
এই বুটজুতোয় থেঁতলানো স্বপ্নগুলোর যন্ত্রণা তুমি অনুভব করতে পারনি।
বারবারা (আবেগপ্রবণ হয়ে):
কিন্তু আসাদ, আমি কাঁদতে জানি,
আমি দেখেছি গির্জার মেঝেতেও ধর্ষিতা নারীদের─
আমি তো নারী হয়ে বুঝি, এ কেমন মরণ
তবে কেন, আমার চোখের পানি তোমার কাছে পৌছে দিতে পারিনি?
কেন আমার হৃদয়ের দরোজা তোমার বেদনা ঠেকাতে পারলো না?
দৃশ্য ২: চিঠির সূত্রপাত
(মঞ্চে আসাদ। যু’দ্ধ’বি’ধ্বস্ত গ্রামের মধ্যে তিনি হাঁটছেন। বাতাসে পোড়া ধানের গন্ধ। আকাশে মেঘের ছায়া। মোমের আলো জ্বলছে। হাতে বারবারার উদ্দেশ্যে লেখা একটি চিঠি।)
আসাদ (স্বগত):
“বারবারা, তুমি লিখেছিলে—’তোমারা কি বুঝবে, ভি’য়ে’তনামের যুদ্ধ কি?
তার প্রত্যেকটা শোক আর যন্ত্রণার কথা!’
আমি পড়েছিলাম। তোমার সেই লেখায় হৃদয়ে যে ঝড় উঠেছিল, সেটাই আমাকে পথে নামিয়েছিলো।
তুমি কি জানো, প্রিয় বারবারা, আমাদের ভয়াবহতা কেমন ছিল? পনেরো লক্ষ মানুষ নিঃশব্দে মরে গেছে। একেকটা শরীর অন্যায়ের চিহ্ন ধারণ করেছে।
তুমি কি জানো, কেমন লাগে যখন ভাইয়ের রক্ত, বোনের সম্ভ্রম মাটিতে মিশে যায়, অথচ তুমি কিছুই করতে পারো না?”
(মোমের আলো ম্লান হয়ে যায়, দূর থেকে বু’লে’টে’র আওয়াজ শোনা যায়।)
দৃশ্য ৩: বারবারার প্রতিক্রিয়া
(ইউরোপীয় ক্যাফেতে বসে বারবারা। তাঁর সামনে একটি কাগজের টুকরো। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি। এক হাতে কফির মগ, অন্য হাতে কলম।)
বারবারা ( মুখে অপ্রতিভ হাসি):
“আসাদ, তোমার সেই লেখা পড়ে আমার শিরায় শিরায় কাঁপন ধরেছিল। তুমি যু’দ্ধে ছিলে—তোমার জন্য আমি লিখিত ক্ষোভ ছাড়া আর কিছু করতে পারিনি।
আমি জানতে চেয়েছিলাম, মানুষের মধ্যে কীভাবে এতটা নৃশংসতা আসে? তুমি কি জানো, আমার চোখ যখন তোমার লেখা পড়েছিল, তখন আমার হৃদয় একসঙ্গে কেঁপে উঠেছিল?
কিন্তু আমি—আমি তো সভ্যতা আর শিল্পের মধ্যেই বেঁচে আছি। তোমাদের সেই যন্ত্রণা আমি কীভাবে অনুভব করব?
আমি কি তবে শুধু নিরব দর্শক হয়ে থাকব, আসাদ? আমি কি কেবল দূরে বসে কাঁদব, আর কিছুই করতে পারব না?
দৃশ্য ৪: [মঞ্চের বিবরণ]
মঞ্চের পেছনে ঘন অন্ধকার, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। মঞ্চের মাঝখানে একটি মোমবাতি জ্বলছে, আলোর ছায়ায় আসাদ ও বারবারার মুখ ভেসে ওঠে।
আসাদ (গম্ভীরভাবে, মোমবাতির দিকে তাকিয়ে):
দ্যাখো, এই আলোটা যেন আমাদের শেষ ভরসা,
কিন্তু এই আলোটাও ক্রমশ নিভে যাচ্ছে বারবারা।
আমাদের সাধারণ মানুষগুলো, যারা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলো─
তাদের চিতার আগুনে এই আলোটা নিভে যাওয়ার পথে।
বারবারা (মোমবাতির শিখায় হাত ছুঁতে চেষ্টা করে):
তুমি কি মনে করো, আমাদের সবার মধ্যেই এই আ’গু’ন নিভে যাচ্ছে?
আমার ভেতরেও কি সেই আ’গু’ন ছিল না?
যেটা আমি কখনো নিভতে দিইনি
যে আ’গু’ন সেদিন লক্ষ মানুষের বুকে একইভাবে জ্বলেছিল…!
আসাদ (ধীর কণ্ঠে, ক্ষোভ মেশানো):
তুমি কি এসব অনুভব করতে পারবে, বারবারা…!
কিন্তু আমাদের জন্য প্রতিদিন এই আ’গু’নটাই জ্বলেছে।
যে স্বপ্ন, যে স্বাধীনতা আমরা খুঁজছিলাম,
তা শুধু আমাদের শরীরকে পুড়িয়ে দিচ্ছে,
আর তুমি দূরে বসে কেবল দেখেছ, অনুভব করেছ,
কিন্তু… তুমি সেই আ’গু’নের শিখায় হাত ছোঁয়াওনি।
দৃশ্য ৫: [মঞ্চের বিবরণ]
একটি ছোট ঘর। আসাদ একটি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে, তার হাতে কিছু পত্রিকা। বারবারা দূরে বসে তাকে দেখছে। জানালার বাইরে বৃষ্টি তীব্র হচ্ছে।
আসাদ (পত্রিকাটি বারবারার দিকে ছুঁড়ে দেয়):
দেখো, বারবারা।
এটা জল্লাদ দাঁতাল শুয়োরের ছবি─
তোমাদের কাগজগুলোও নিশ্চয়ই ছাপিয়েছে,
কিন্তু জানো, এ ছবির পেছনে লুকিয়ে আছে রক্তের স্রোত
পনেরো লক্ষ মানুষের রক্তে তাদের হাত লাল,
যারা আমাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে,
স্বাধীনতা, মানবতা- আমার সম্ভ্রম… আমাদের সূর্য
বারবারা (শান্তভাবে পত্রিকাটি হাতে তুলে নেয়):
আমি বুঝতে পারি, আসাদ,
কিন্তু এই রক্তের ধারা আমার কাছে এত স্পষ্ট ছিল না।
আমার মনের চোখ কেবল দেখেছে যুদ্ধের কষ্ট─
কিন্তু এত বিশাল ক্ষয়, এত মৃ’ত্যু, এত বেদনা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
(কিছুক্ষণ চুপ)
তুমি যদি আমাকে দেখাতে পারো,
কিভাবে একটা দেশের সকাল চুরি হয়ে যায়,
আমি সত্যিকারের যুদ্ধে তোমার পাশে দাঁড়াবো।
দৃশ্য ৬: যুদ্ধের গভীরে
(আসাদ যুদ্ধের ময়দানে। নীরবচ্ছিন্ন সঙ্গীহীন। তার হাতে ছিন্ন কাগজ।)
আসাদ:
“বারবারা, তুমি জানো না, কী ভয়াবহ এই পৃথিবী?
তুমি বলেছিলে, তুমি যুদ্ধে নামবে। কিন্তু তুমি জানো না, যুদ্ধ মানে কী।
যুদ্ধ মানে শুধু মৃত্যু নয়, যুদ্ধ মানে স্বপ্নের ভগ্নাংশ।
তুমি জানো কি, বারবারা, যুদ্ধ মানে নিজের আত্মাকে বিক্রি করে দেয়া। প্রতিটি মুহূর্তে নিয়ন্ত্রিত মৃত্যুর আতঙ্ক।
তুমি বলেছিলে তুমি আমার যুদ্ধে থাকবে। কিন্তু তুমি তো আমার যুদ্ধের সঙ্গে নিজেকে মিলাতে পারবে না,
এসব কেবল তুমি শব্দেই আঁকতে পারবে।”
দৃশ্য ৭: [মঞ্চের বিবরণ]
মঞ্চের পেছনে একটি বড় প্রজেকশ্যনে বাংলাদেশের মু’ক্তি’যু’দ্ধের দৃশ্য ফুটে ওঠে। বো’মা’র ধোঁয়া, পু’ড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি, আতঙ্কিত মানুষের চি’ৎকা’র শোনা যায়। আসাদ ও বারবারা মাঝমঞ্চে দাঁড়িয়ে। প্রজেকশ্যন পর্দায় বারবারার বি’স্ফো’রিত দৃষ্টি..!
আসাদ (প্রজেকশনের দিকে হাত বাড়িয়ে):
বারবারা, দেখো,
এটা আমার দেশের যু’দ্ধ,
আমার মানুষের স্বপ্ন আর লড়াই─
তুমি কি বুঝতে পারছো,
এখানে শুধু স্বা’ধী’ন’তার জন্য লড়াই হচ্ছিল না,
এখানে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন ছিল,
আমাদের সত্তার, সংস্কৃতির জন্য লড়াই ছিল।
বারবারা (বিস্মিত হয়ে প্রজেকশনের দিকে তাকিয়ে):
এত ভয়াবহ!
আমি কেবল ভেবেছিলাম যু”দ্ধ’টা অন্যরকম হবে─
কিন্তু তুমি যা দেখালে…
এটা আমার সমস্ত কল্পনাকে পেরিয়ে গেছে।
কেন কেউ আমাকে আগে এভাবে দেখায়নি?
দৃশ্য ৮: আলো-আঁধারের পথে
(আসাদ যেন যু’দ্ধে’র মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছেন। মঞ্চের আলো আস্তে আস্তে কমে যায়, যেন চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। দূর থেকে গো’লা’গু’লি’র শব্দ।)
আসাদ (আকাশের দিকে তাকিয়ে):
“তুমি জানতে চেয়েছিলে, বারবারা, আমি কেন লড়াই করছি। আমি কিসের জন্য মৃত্যুর মুখে যাচ্ছি।
তুমি বুঝতে পারবে না। কারণ তুমি বসে আছো কেবল সমৃদ্ধির মধ্যে, প্রগতির আলোয়। কিন্তু আমি বেঁচে আছি, প্রতিটি মুহূর্তে মৃ’ত্যু’কে সামনে রেখে।
আমাদের এই যন্ত্রণা কেউ দেখছে না। আমাদের বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলে উঠছে,
সেটার সাক্ষী হয়তো তুমি হবে না, কিন্তু আমি চাই তুমি শুনবে।”
দৃশ্য ৯: [মঞ্চের বিবরণ]
মঞ্চে কিছুটা অন্ধকার, মাঝে মাঝে টেবিলের উপর রাখা একটি ঘড়ির টিকটিক শব্দ শোনা যায়। আসাদ এবং বারবারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে।
বারবারা (ঘড়ির দিকে তাকিয়ে):
তুমি বলেছিলে, সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে,
কিন্তু আমি এখন অনুভব করছি,
এই মুহূর্তগুলো যেন থেমে আছে…
যেন আমাদের এই আলোচনার শেষ নেই,
এই যু’দ্ধে’র শেষ নেই।
আসাদ (আধো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে):
আমাদের সময় থেমে আছে,
কিন্তু যু’দ্ধে’র সময়, মানুষের মৃ’ত্যু’র সংখ্যা থামছে না।
তুমি অনুভব করেছ বারবারা,
কিন্তু সত্যিকারের যু’দ্ধে আমরা বারবার হেরে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের’কে উঠে দাড়াতেই হবে…
(চোখের কোণে একফোঁটা জল জমে)
আমাদের স্বপ্নগুলো থেমে থাকছে,
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে।
বারবারা, এসো এই কালো হাতগুলো’কে আগে আমরা চিনতে চেষ্টা করি
তারপরে আমার নতুন যু’দ্ধ শুরু হবে…
যবনীকা
(মঞ্চে একটা মৃদুলয়ে বাতাস বইতে শুরু করে। আসাদ ও বারবারা যেন কোনো একটি ইঙ্গিত পায় আত্মায়, একে অপরের দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকে। যেন সেই নীরব মুহূর্তে তারা দুজনই নতুন কোনো উপলব্ধিতে পৌছেছে। মোমমাতির শিখা ধীরে ধীরে চঞ্চল থেকে চঞ্চলতর হয়ে উঠছে…, এবার বজ্রের ধ্বনি শুরু হয়েছে… আসাদ ও বারবারার দুজনের চোখ, সেই বজ্রদ্যুতিতে ঝিকমিক করে উঠলো… দ্রোহ উদ্দীপনা ও শেকল ভাঙার সুর বেজে উঠছে)
একটি শিশিরের শব্দিতা প্রযোজনা © ২০২৪