অতীত বর্তমান
অতীত বর্তমান
অরবিন্দ সরকার
ভোম্বল দাস তার একমাত্র ছেলে সম্বল কুমারকে সন্ধ্যাবেলায় তাঁদের পরিবারের অতীত দিনের স্মৃতি কথা বলছে। সম্বল টিভির সামনে বই খুলে বাপের কথা শুনছে।
ভোম্বল শুরু করলো – আমরা পড়তে যেতাম দুই ক্রোশ দূরে খাপসাডাঙা হাইস্কুলে। ছেলে মেয়ে দল বেঁধে যেতাম,ছাতা ঘাড়ে, টিফিন কৌটায় ছাতু, পেঁয়াজ, মুড়ি,ও বইয়ের ঝোলা শক্ত কাপড়ের তৈরি থাকতো ছাতার পিছনে। হ্যান্ডেল কলম জিভ ছাড়া,ও হাতে কালির দোয়াত। মা কালি বানিয়ে দিতো। সকালে বেলায় ঘুম থেকে উঠে গুরুজনদের প্রণাম, তারপর পড়াশোনা,পুকুরে চান করে, ডিম ভাজা দিয়ে মাড় ভাত খেয়ে সকাল সাড়ে নয়টার সময় স্কুল যাত্রা। মা রাতের বেলায় ধান সেদ্ধ, ভোরবেলায় মুড়ি ভাজা, সকালের আমাদের ভাত, বিকেলে ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল ছাঁটাই, একহাঁটু কাদা ভেঙে দূরবর্তী টিউবওয়েল থেকে খাবার জল নিয়ে আসতো। তার আগে পুকুরের জল ফিটকিরি দিয়ে শোধন করে খেতাম।
মায়ের খাওয়া,ঘুম দেখতে কোনোদিন পেতাম না। বাবা সারাদিন মাঠেঘাটে জমির আইলে ফসল পরিচর্যা করতো। তখন সবজি তেমন শীতকাল ছাড়া পাওয়া যেতো না। বেশীরভাগ সময় ডালের বড়া, হাঁসের ডিম, বাড়ীর আনাচে কানাচে গজিয়ে ওঠা শাক রান্না হতো। বিকেলে খেলতাম হাডুডু, ডাংগুলি, লুকোচুরি, সন্ধ্যার সময় মায়ের তুলশী তলায় প্রদীপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠোনে তালপাতার মাদুর বিছিয়ে হ্যারিকেন ও কুপির আলোয় পড়াশোনা করতাম। বাবার শাসনে পড়াশোনার সময় গল্প গুজব করা যেতো না। গল্প করলেই গরু চড়ানো পাঁচন দিয়ে উদোম মার মারতো। স্কুলে পড়া না হলে মাষ্টারমশাইয়ের বেতের চাবুকে পিঠে, হাতে লাল দাগ পড়তো। বাড়ীতে মাষ্টারমশাইয়ের পিটুনি বলা যেতো না। বাবা শুনতে পেলেই আবার ভাগ্যে পিটুনি জুটবে তাই!
একান্নবর্তী পরিবার ভাঙচুর শুরু হয়েছে তখন। শিক্ষা চাকুরীর জন্য ছিলো না। চাকুরী এগিয়ে আসতো পাশ করলেই। তখন ম্যাট্রিক পাস করলে দূরের গ্রাম থেকে দেখতে আসতো। সরস্বতী পূজার ধূম ছিলো। তখন মণ্ডপে গ্রামে সরস্বতী পূজা হতো একটি দুটি।দুর্গা পূজা পাঁচ খানা গ্রামের মধ্যে হয়তো একখানা ছিলো ঠাকুর বাড়ীতে। ঠাকুরের নামে তিন চারশো বিঘা জমি থেকে পুজোর আয়োজন ছিলো। ওখানে পুজো হতো, পুজোয় জামা প্যান্ট- পাট চাষের, পাট বিক্রি করে ছিট কিনে গ্রামের দর্জি সেলাই করতো। হয় জামার হাতা ছোট বড়ো হতো, নয়তো প্যান্ট ছোট বড়ো হতো। ওতেই আনন্দ পেতাম।
আর এখন ডিজাইনের নিত্যনতুন জামাপ্যান্ট, তরিতরকারি বারোমেসে হাইব্রিড। ছেলে মেয়ে তারাও সব হাইব্রিড জাতীয়। না চাইতেই সব মিলছে। স্কুলে গেলেই ম্যাট্রিক পাস। লেখাপড়ার বালাই নেই। গুরুজনদের সম্মান দিতে কেউ জানে না এখন। পিছন ফিরে বিড়ি সিগারেট ফুঁকছে সব। কেউ আবার বড়োদের কাছ থেকে দিয়াশলাই বা লাইটার চাইছে। লোকলজ্জা মানসম্মানের ব্যাপার নেই। আমাদের লজ্জায় মাথা হেঁট ক’রে পিছুপা হ’য়ে পিঠটান দিতে হয়। মদ ছাড়া পুজো মানায় না,তাই সীমাহীন মাতলামি, ডিজের তালে ভূতুড়ে নৃত্য চলছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পুজোর সংখ্যা বাড়ছে অনুদানে। পরের টাকায় পোদ্দারী? চাঁদার জুলুম এখন আবার বেড়েছে।কারণ মদের দাম বেড়েছে তাই! ভালোবাসা পথে পথে গড়াগড়ি খাচ্ছে,কে কখন কাকে ভালোবাসছে আবার ছাড়ছে এটা ভগবানের জানার সাধ্যের বাইরে। সাতপাকে বিয়ে,মন্ত্রোপাঠ, পুরোহিতের ধ্রুবতারা সাক্ষী রেখে সিঁদুর দান,ও ঘোমটা টেনে দেওয়া সব শেষ। এখন ঘোমটা ছেড়ে খ্যামটা! সিঁদুর দেখায় যায়না সিঁথিতে। শাঁখা আলতা সব বেমানান এখন? মেয়ের অভাব এখন, সবাই ছেলে চায়! তাই ভাতারকে ভাত দিতে বাধ্য? শাড়ি ধুতি সব উঠে গেছে। লেহেঙ্গা, জিন্সের প্যান্ট ও সার্ট পড়ছে মেয়েরা। পুরুষ নারী বোঝা শক্ত। ভালো ভালো ঘরের মেয়ে তারা সিগারেট ফুঁকছে প্রকাশ্যে। হাঁটুর নীচে দুলছে খুকির গোছা ভরা চুল,এ সব কবিতার মৃত্যু হয়েছে, তাছাড়া চুল বয় কাট ছাঁট। হানিমুন কতো বার যে হচ্ছে পাহাড় পর্বত সমুদ্রে অথবা বিদেশে তার ইয়াত্তা নাই।টাকা পয়সা এখন খোলামকুচি! বাড়ীতে কাজের মেয়ে, রান্নার মাসী, বাচ্চা হলে তার দায়িত্বে আয়া মাসী! আমাদের মা ছিলো দশভূজা। সব একাই সামলেছে। এখন মোবাইল ছাড়া পেটে ভাত ঢুকে না? কম্পিউটার ছাড়া লেখা পড়া হয়না। হ্যালো তে সব শেষ। রাস্তা ঘাট বাড়ি বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত। তবুও রাস্তায় আলোবাতি ভেঙে তার নীচে খুঁটিতে হেলান দিয়ে চলছে প্রেমালাপ। কোথাও আবার আলো লজ্জা পেয়ে ফিউজ হয়ে যায়। ছিলোনা তখন বৃদ্ধাশ্রম, এখন শহরের বুকে গড়ে উঠছে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধাশ্রম। কে কতো যত্ন নেবে তার প্রচার। ছেলে বৌ তারা তাদের বাপ্ মাকে দেখাচ্ছে,দেখো কোনটা ভালো? আমরা তো সবসময় থাকিনা,তাই তোমাদের ওখানে থাকাই ভালো। তাছাড়া তোমরা সেকেলে? এখনকার সঙ্গে খাপ্ খাওয়াতে পারবে না। তাছাড়া আমাদের সন্তান সব তোমাদের মতো গেঁয়ো হয়ে যাবে। আচার আচরণ পার্টি তোমরা থাকলে মাটি হয়ে যাবে! এই সব বলতে বলতে ভোম্বলের চোখে জল এলো,ভোম্বলের বউ তার চোখের জল কাপড়ের আঁচলে মুছিয়ে দিলো। ভোম্বল তার ছেলেকে বললো দ্যাখ্ এটাই প্রেম ভালোবাসা। মরা পর্যন্ত সে আমার সঙ্গে আছে ও থাকবে! উলু দিয়ে সাক্ষী রেখে বিয়ে করার ফল এরকমই হয়। কেউ কাউকে ছাড়তেই চাইনা আমরা। এটাই প্রকৃত কাঁঠালের আঠা! লাগলে পরে ছাড়ে না!